ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছেলের চাকরির জন্য সব হারানো এক নিমাই ঢালীর আর্তি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১ মে ২০১৭

ছেলের চাকরির জন্য সব হারানো এক নিমাই ঢালীর আর্তি

স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা ॥ কাদের মোল্লার ফাঁসির দিন জামায়াতীরা পুড়িয়ে দিয়েছিল তার ছেলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এরপর বেঁচে থাকার তাগিদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি কাম প্রহরী পদে ছেলে রাজকুমার ঢালীর চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করেন তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আবুর খায়ের সরদার বলেছিলেন কিছু টাকা খরচ করলে তিনি ছেলের চাকরির জন্য যোগাযোগ করে দেবেন। কথামতো তিনি যোগাযোগ করে দেন সদর আসনের সংসদ সদস্যসহ মধ্যস্থতাকারী অনেকের সঙ্গে। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেও চাকরি হয় না তার ছেলে রাজ কুমার ঢালীর। মাঝখান দিয়ে চলে যায় তার সহায়-সম্বল বিক্রি করে দেয়া সাড়ে চার লাখ টাকা। পঙ্গু হওয়ার কারণে হারাতে হয় জীবন-জীবিকার রাইস মিলের কাজটি। ছেলের চাকরির আশ্বাসে ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা। সঙ্গে বাগদা চিংড়ি, কৈ, ভেটকি মাছ, আঙ্গুর, আপেল, কলা ও মিষ্টি ছিল বোনাস। এরপর বাছাই পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি হয়নি রাজ কুমারের। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ঘুষের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ টাকা। এ কারণে বাছাই পরীক্ষায় ৬ নম্বরে থেকেও চাকরি হলো অসীমের। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নিয়োগের দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণ হওয়ার পরও চাকরি হয়নি রাজ কুমার ঢালির। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৯৬নং ব্যাংদহা প্রাইমারী স্কুলে দফতরি কাম প্রহরী নিয়োগে অনিয়মের এই চিত্র তুলে ধরে প্রতিকার ও বিচার প্রার্থনা করে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সব হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া প্রতারণার শিকার নিমাই ঢালী। সাতক্ষীরা সদর-২ আসনের সংসদসহ তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যনের কাছে। আর অনুলিপি দেয়া হয়েছে জাতীয় সংসদের স্পিকার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে। তবে সাতক্ষীরা ২ আসনের সংসদ সদস্য তার বিরুদ্ধে নিমাই ঢালীর আনা টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে রবিবার দুপুরে জনকণ্ঠকে বলেন, আমি টাকা নেই নাÑআমি টাকা দেই। মনোনয়ন বঞ্চিত তার প্রতিপক্ষ জামায়াত-সংশ্লিষ্ট কিছু লোক নিমাই ঢালীকে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করিয়েছে দাবি করে এমপি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, এই চাকরির জন্য এত টাকা সে কেন দেবে এবং এত লোককেই বা সে কেন টাকা দিতে যাবে? ঘুষের টাকা লেনদেনকারী অনেকেই ফেরত দিয়েছে নিমাই ঢালীর এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা টাকা লেনদেন করেছে এটি তাদের ব্যাপার। এর সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই। গত ২৩ এপ্রিল বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর শনিবার দুই ছেলের ঘাড়ে ভর দিয়ে নিমাই ঢালী এসেছিলেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে। সাংবাদিকদের সামনে অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তিনি ছিলেন রাইস মিলের কর্মচারী। সারা জীবনের অর্জিত অর্থ ঘুষ দিয়েও তিনি ছেলের চাকরিটা করাতে পারেননি। টাকা ফেরত চেয়ে অপমানিত হয়ে স্ট্রোক করে তিনি নিজেই প্যারালাইজড হয়ে পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। সাংবাদিকদের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি ন্যায়বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। নিমাই চন্দ্র ঢালী বলেন, ২০১৪ সালে তার ছেলে রাজ কুমার ঢালী সদর উপজেলার ব্যাংদহা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি কাম প্রহরী পদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে। তিনি অভিযোগ করেন ছেলের চাকরির আশায় নিয়োগ পরীক্ষার আগে ফিংড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যানকে ২০ হাজার টাকা দেন। পরে তার কথামতো ব্যাংদহা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ও সহসভাপতি ২ লাখ টাকা দেন। পরে সাবেক চেয়ারম্যান তাকে ফোন করে জানান, ৫০ হাজার টাকা সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্যকে রবিকে দিতে হবে। সে কথা মোতাবেক, গাছ বিক্রি করে তিনি ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করে সাতক্ষীরা শহরে আসেন। শহরের এক ভিসা অফিসে বসে তিনি সংসদ সদস্যকে দেয়ার জন্য একটি পত্রিকার সম্পাদকের হাতে ৪০ হাজার টাকা প্রদান করেন। টাকাটি গুণে সম্পাদক পকেটে রাখেন। নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পাশাপাশি এতগুলো টাকা দিয়েও ছেলের চাকরি না হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ছেলের চাকরির আশায় এ দ্বার থেকে ও দ্বারে হাঁটতে থাকেন নিমাই চন্দ্র ঢালী। পরবর্তীতে তার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্র আরও টাকা হাতানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ফাঁদ পাততে থাকে। সংসদ সদস্যকে ম্যানেজ করার জন্য ওই সম্পাদককে আরও ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। তাতেও চাকরি হয়নি। বাড়তে থাকে ঘুষের অঙ্ক। নিমাই চন্দ্র ঢালী অভিযোগে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পর এত টাকা দিয়েও ছেলের চাকরি না হওয়ায় তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধ হলে সাংসদ তাকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, চাকরি পেতে তাকে আরও খরচ করতে হবে। এরপর আরও কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। নিমাই ঢালীর লিখিত অভিযোগ অনুযায়ী, শুধু টাকাই নয়, প্রতারকরা চাকরি দেয়ার আশ^াসে বিভিন্ন সময়ে বাগদা চিংড়ি, কৈ, ভেটকি মাছ, আপেল, কলাসহ বিভিন্ন ফল-ফলাদি নিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করেছে। সাড়ে চার লাখ টাকা ও এত কিছু দেয়ার পরেও তার ছেলের চাকরি হয়নি। চাকরি পেয়েছে নিয়োগ পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকারী অসিম কুমার দাশ। নিমাই ঢালী বলেন, ছেলের চাকরি না হওয়ায় তিনি টাকা গ্রহণকারী ব্যক্তির বাড়িতে যান টাকা ফেরত চাইতে। তবে টাকা ফেরত পাওয়ার পরিবর্তে তিনি চরমভাবে লাঞ্ছিত হন। এই শোকে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। এতে প্যারালাইজড হয়ে বর্তমানে পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। ফলে তার চালকলের চাকরিটাও চলে যাওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন তিনি। অভিযোগপত্রে তিনি কিছু টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। সংসদ সদস্যের ভাই তার বাড়ির দ্বিতলা থেকে ব্যাগে দড়ি বেঁধে এক লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন। ব্যাংদহা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহসভাপতি তাকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন। আর এক শিক্ষা অফিসার ফেরত দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে রবিবার জনকণ্ঠকে বলেন, আমি শুধু যোগাযোগ করে দিয়েছিলাম মাত্র। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে সংসদ সদস্যের পিএস হাকিম নিতাই ঢালীর কাছ থেকে টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
×