ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চুড়ি নেবেন গো, চুড়ি... রেশমী থেকে জয়পুরী সব মেলে মালতির কাছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৮ এপ্রিল ২০১৭

চুড়ি নেবেন গো, চুড়ি... রেশমী থেকে জয়পুরী সব মেলে মালতির কাছে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘চুড়ি নেবেন গো চুড়ি। ইন্ডিয়ান চুড়ি আছে। আছে রং-বেরঙের চুড়ি।’ উচ্চস্বরে কথাগুলো বলছিলেন এক মধ্যবয়সী নারী। তিনি একজন চুড়ি বিক্রেতা। শাহবাগের রাস্তার ফুটপাথে চুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছেন তিনি। পাশ দিয়ে যে কোন নারীকে হেঁটে যেতে দেখলেই তিনি চুড়ি কিনতে ডাকছেন। শুক্রবার বিকেল থেকেই এ এলাকায় বিনোদনপিয়াসীদের আনাগোনা বেশি থাকে। তাই এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর লক্ষ্য বিনোদনপিয়াসী নাগরিকরা। অনেকে তার সামনে বসে চুড়ি পছন্দ করছেন অনেকে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। পছন্দের চুড়ি ক্রেতাদের হাতে পরিয়ে দিচ্ছেন সেই মধ্যবয়সী নারী। অনেক ক্রেতা তাদের পছন্দ মাফিক চুড়ি কিনছেন আবার অনেকেই হাত থেকে চুড়ি খুলে রেখে চলে যাচ্ছেন। কথা বলে জানা গেল, এই চুড়ি বিক্রেতা মধ্যবয়সী নারীর নাম মালতি বেগম। চুড়ি বিক্রি করেই তার সংসার চলে। সাত রাস্তার পাশের একটি বস্তিতে মাসিক পনেরশ টাকা ভাড়ায় ঘর নিয়ে বৃদ্ধ স্বামীর সঙ্গে থাকেন তিনি। স্বামী অসুস্থ, তাই সংসারের সব দায়িত্বই তার কাঁধে বলে জানালেন মালতি। ১০ ভাইবোনের অভাবের সংসারে জন্ম নেয়ায় মালতি বেগম খুব অল্প বয়স থেকেই চুড়ি বিক্রি শুরু করেন। পেট চালানোর জন্য ময়মনসিংহ নিজ জেলা ছেড়ে ভাগ্যের সন্ধানে ঢাকা আসেন। অল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করেন চুড়ির ব্যবসা। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দের মাঝেই মালতি বেগম তার জীবনের পঁচিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় রং- বেরঙের চুড়ির পসরা সাজিয়ে বসে সেগুলো বিক্রি করাই তার কাজ। চুড়ি বিক্রির এ পেশাকে মালতি বরাবর নিজের নেশা হিসেবেও বেছে নিয়েছেন। তাই তো তিনি এখনও চুড়ি বিক্রির মাঝেই মজা খুঁজে বেড়ান। অন্য কোন কাজে গেলে মন বসে না তার। মালতি বেগমের বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়। সংসারে তার অবলম্বন অসুস্থ বৃদ্ধ স্বামী। তাই ভরণ-পোষণ ও সংসার চালানোর ভার এ মধ্যবয়সী নারীর ওপর। দুই ছেলে থেকেও না থাকার মতোই বলে জানালেন মালতি। বলেন, ‘দুই পোলা নিজেরাই বিয়া কইরা বউ লইয়া গ্রামে থাহে। আমারে আর ওর বাপেরে দেহে না। আমরা মরলাম না বাঁচলাম তাও দেখবার আহে না। সন্তান জন্ম দিয়া কোন লাভ নাই।’ সকাল ১০টা থেকে মালতি বেগমের ব্যবসা শুরু হয়। তবে তার এ ব্যবসার নেই কোন নির্দিষ্ট স্থান। কখনও এ রাস্তায় কখনও বা অন্য রাস্তায়। এভাবেই চলে তার চুড়ির ব্যবসা। গত এক মাস যাবৎ শাহবাগসংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির অপর পাশের রাস্তায় চুড়ির পসরা সাজিয়ে বসছেন তিনি। কিন্তু তবুও মাঝেমধ্যেই পুলিশের দৌড়ানি খেতে হয় বলে জানালেন তিনি। মালতি বলেন, ‘সময় পাইলে শাহবাগের এ রাস্তায় বসি। রাত ১০টা পন্ত (পর্যন্ত) বিক্রি করি। আমাগো ব্যবসার নির্দিষ্ট কোন জায়গা নাই। পুলিশ এসে উঠাইয়্যা দিলে তহন আবার অন্য জায়গায় বসি। এমনেই সারাদিন এক জায়গা তন অন্য জায়গাত উঠার কারণে ভালভাবে ব্যবসাও করবার পারি না। বিকাল থেকাই ভালো বিক্রি হওন শুরু হয়। ওই সময়কাই পুলিশ আইবো, আর উঠাইয়্যা দিবো। আমাগো যদি একটা কোনা আলাদা জায়গা থাকত তাইলে আমরা ভালভাবে ব্যবসা করবার পারতাম।’ চক বাজার থেকে ইন্ডিয়ান চুড়ি পাইকারিভাবে কিনে নিয়ে আসেন মালতি। তিনি জানালেন, ‘ইন্ডিয়ান চুড়ির কদরই বেশি। এডির (এগুলোর) রঙ উঠে না। তয় সবচেয়ে বেশি রেশমি চুড়ি বিক্রি হয় এহানে। রেশমি চুড়ির কদর চিরকাল। হাতে পরলেও সুন্দর দেহায়।’ অল্প বয়সের তরুণীরা সবচেয়ে বেশি চুড়ি কেনে বলে জানান মালতি। কত রকমের চুড়ি আছে জিজ্ঞাসা করতেই মালতি দেখিয়ে বললেন, ‘রেশমি, খাজকাটা, কিরণমালা, জোনাকি, জয়পুরী, রংধনু, মেটালের চুড়ি আছে।’ তার চুড়ির দাম ৪০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। একডজন রেশমি চুড়ি ৪০-৫০ টাকা, খাজকাটা প্রতি ডজন ৫০-৬০ টাকা, জোনাকি চুড়ির সেট ৭০-৮০ টাকা, জয়পুরী চুড়ির সেট ১০০-১৫০ টাকা, রংধনু ১০০-১২০ টাকা, কিরণমালা সেট ৫০-৬০ টাকা, মেটালের চুড়ি ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত। গড়ে প্রতিদিন এক হাজার টাকার চুড়ি বিক্রি করেন মালতি। এই টাকার মধ্যে তিন থেকে চারশত টাকা লাভ হয় তার। এর থেকেই ঘর ভাড়ার টাকা জমাতে হয়। সঙ্গে আবার অসুস্থ স্বামীর ওষুধ কেনার টাকার যোগানও দিতে হয় এ টাকা থেকেই। আর দৈনন্দিন বাজার-সদাই তো করতেই হয়। চুড়ি বিক্রির কিছু বিশেষ দিন রয়েছে বলে জানালেন মালতি। ‘বেবাগ সময় (সবসময়) তো আর চুড়ির ব্যবসা হয় না। বিশেষ বিশেষ দিনে আমাগো বিক্রি বেশি হয়। যেমন ধরেনÑ পহেলা বৈশাখ, ভালবাসা দিবস, পয়লা ফাল্গুন, ২১ ফেব্রুয়ারি এবং বইমেলার পুরো মাসই ভাল বিক্রি হয়। আর কয়দিন পরই পয়লা বৈশাখ তাই কিছু নতুন ডিজাইনের চুড়ি কিইনা আনছি। সুতার কাজ করা চুড়িগুলা বেশ চলতাছে। পয়লা বৈশাখের বেঁচা বিক্রি অহনও শুরু হয় নাই। তয় কাস্টমার আসতাছে। ১০ তারিখ থেইক্যা ভাল বিক্রি হইব আশা করতাছি।’ কিন্তু এখনও তো আবার হরহামেশাই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে বজ্রসহ বৃষ্টি দেখা দিচ্ছে। এ কারণে একটু চিন্তিত মালতির মতো চুড়ি ব্যবসায়ীরা। পয়লা বৈশাখের মতো বিশেষ দিনগুলোতে বিক্রির জন্যই মুখিয়ে থাকেন এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তারপর আবার তাদের নেই কোন নির্দিষ্ট স্থান।
×