ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীরা পালাচ্ছে ভারতে, ঢাকায় গ্রেফতার ৫

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২২ মার্চ ২০১৭

জঙ্গীরা পালাচ্ছে ভারতে, ঢাকায় গ্রেফতার ৫

শংকর কুমার দে ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গীবিরোধী ব্যাপক অভিযান ও কঠোর নজরদারির কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গীদের ভারতে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। জঙ্গী গোষ্ঠী নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গী নেতা সারোয়ার ও তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নতুন করে জঙ্গী সংগঠন সংগঠিত করার নেতৃত্ব দিচ্ছে কে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে নব্য জেএমবির দুই প্রকৌশলীসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। রাজধানীর আশকোনার র‌্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প ও খিলগাঁওয়ের র‌্যাব চেকপোস্টে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলাকারী নিহত দুই জঙ্গী এখনও পরিচয় মেলেনি, অজ্ঞাত। তদন্তকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া এক চিঠিতে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গীদের ভারত যাওয়ার প্রবণতা তিন গুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারকে এই বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছর সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গীদের ভারতে যাওয়ার প্রবণতা তিন গুণ বেড়ে যাওয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম (হুজি) ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) মতো জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় প্রবেশের প্রবণতা তিন গুণ বেড়েছে বলে ঢাকার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে দিল্লীকে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালে হুজি ও জেএমবির আনুমানিক ২০১০ জন ভারতের তিনটি রাজ্যে প্রবেশ করেছে, যার মধ্যে ৭২০ জন পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা জঙ্গী প্রবেশের সংখ্যা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কর্মকর্তাদের সন্দেহ থাকলেও তারা বিষয়টি ‘উদ্বেগজনক’ বলেছেন। তাদের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ৮০০ এবং পরের বছর ৬৫৯ জন জঙ্গী ভারতে প্রবেশ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারত সরকার তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়টি যাচাই করে দেখার চেষ্টা করছে। আসাম পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিচালক পল্লব ভট্টাচার্য এর উদ্বৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় তিনি এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, তারাও গত ছয় মাসে জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখতে পেয়েছেন। আসাম পুলিশ ইতোমধ্যে ৫৪ জন জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতারও করেছে। জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ইফতাদুর রহমান গত ১২ জানুয়ারি ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভারতে প্রবেশের পর আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে তার সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বলে গোয়েন্দাদের বিশ্বাস। অতীতে সিলেট ও কুমিল্লা সীমান্ত হয়ে জঙ্গীদের ভারতে প্রবেশের প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। পরে তারা পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের অন্যান্য স্থানে সরে যায় বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। আসামে বাংলাভাষী অঞ্চলে একটি চক্রের মাধ্যমে তারা ভারতীয় পরিচয়পত্র, এমনকি জাল পাসপোর্টও তৈরি করিয়ে নেয়। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনের বিষয়টি নজরে এলে সেই বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হবে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও কূটনৈতিক পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার জন্য দুই দেশেই জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালের অক্টোবরে বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় জেএমবির সম্পৃক্ততা পাওয়ার পর ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থাÑ এনআইএর কর্মকর্তারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করা অব্যাহত রেখেছেন। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যের ভিত্তিতে দুই দেশেই বেশ কয়েকজন জঙ্গীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। ভারতের বর্ধমান বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই জঙ্গী নিহত হয়। এ মামলার অভিযোগপত্রেও জেএমবি সদস্যদের জড়িত থাকার কথা বলেছেন ভারতের তদন্তকারীরা। নব্য জেএমবির নতুন নেতা কে? ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, নতুন করে নব্য জেএমবির জঙ্গীদের সংগঠিত করে তৎপরতা চালানোর নেতৃত্ব দিচ্ছে কে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। র‌্যাব বলেছে, সারোয়ার জাহান নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা আর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট বলেছে, নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী। তবে দুই জনেই পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছেন। এখন আবার নতুন করে যে জঙ্গী তৎপরতা বিশেষ করে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা ও আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে তার নেতৃত্ব দিচ্ছে কে? গত বছরের ৮ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ার এক বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়। পরে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই ব্যক্তির প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান এবং তিনি শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফ নাম নিয়ে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে জেএমবির নতুন একটি অংশকে সংগঠিত করেন। সরোয়ার জাহান নিহত হওয়ার আগে গত বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় এক জঙ্গী আস্তানায় অভিযানে নিহত হন তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তিনজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নব্য জেএমবির এই গ্রুপকেই গুলশান ও শোলাকিয়াসহ সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলাগুলোর অধিকাংশ ঘটনায় দায়ী করে আসছে। এই অংশটিকে পুলিশ বলছে ‘নব্য জেএমবি’, আর র‌্যাব বলছে, ‘সারোয়ার তামিম গ্রুপ’। দুই আত্মঘাতী এখনও অজ্ঞাত ॥ গত বছর জুলাই মাসে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মধ্যে কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও চলতি বছরের মার্চের শুরু থেকে বেশ কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে জঙ্গীরা নতুন করে তাদের তৎপরতার জানান দিতে শুরু করে। গত শুক্রবার র‌্যাবের একটি ব্যারাকের সীমানায় ঢুকে পড়ার পর শরীরে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয় সন্দেহভাজন এক জঙ্গী। পরদিন ভোরে খিলগাঁওয়ে একটি তল্লাশি চৌকিতে গুলিতে নিহত হন এক ব্যক্তি, যিনি বিস্ফোরক বহন করছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য। আত্মঘাতী দুই জঙ্গীর লাশ শনাক্ত করার জন্য এখনও কোন আত্মীয়স্বজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আত্মঘাতী দুই জঙ্গীর লাশই এখন বেওয়ারিশ হিসেবে মর্গে পড়ে আছে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ ॥ গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার পর ধরা পড়ে ইমতিয়াজ অমি ও মাহামুদুল হাসান নামের দুই জঙ্গী। তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। গত ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকু- পৌর এলাকার আমিরাবাদের এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ জসিমউদ্দিন ও আরজিনা নামের (সাংগঠনিক নাম) এক জঙ্গী দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রেমতলা এলাকায় আরেক বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গী নিহত হন। পরে বোমায় বিক্ষত এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়। কুমিল্লা ও সীতাকু-ে গ্রেফতার ও নিহত সবাই নব্য জেএমবির সদস্য বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি। নব্য জেএমবির ৫ জঙ্গী গ্রেফতার ॥ রাজধানীর বাড্ডা ও সায়েদাবাদ এলাকায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গী সংগঠন নব্য জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সারওয়ার-তামিম গ্রুপের দুই প্রকৌশলীসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে অলিউজ্জামান অলি (২৮) ও আনোয়ারুল আলম (২৯), সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সালেহ আহাম্মেদ শীষ (২২), আবুল কাশেম (২৭) ও মোঃ মোহন মহসিনকে (২০) আটক করা হয়েছে বলে র‌্যাবের দাবি। মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিএসইসি ভবনে অবস্থিত র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান। তিনি দাবি করেন, র‌্যাব কয়েকটি জঙ্গী হামলার তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানাতে পারে, সারোয়ার-তামিম গ্রুপের যেসব জঙ্গী সদস্য আত্মগোপনে আছে তারা পুনরায় সংগঠিত ও একত্র হয়ে নাশকতার মাধ্যমে নিজেদের সংগঠনকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা নিজ নিজ বাড়ি ত্যাগ করে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ছদ্মবেশে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। তিনি জানান, সোমবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী র‌্যাব ১০-এর একটি দল রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে ওই পাঁচজনকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে বিস্ফোরক, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, জঙ্গীবাদি বই, পিস্তল-বন্দুক, তিন লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং অন্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে বলে র‌্যাবের অতিরিক্ত পরিচালকের দাবি।
×