ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২১ মার্চ ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

গত সপ্তাহেও ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি আবার তাপমাত্রা কমিয়ে দিচ্ছে। যারা লেপ-কম্বল তুলে রেখেছিলেন তারা বিরক্ত ও বিব্রত হয়ে পুনরায় সে সব নামাচ্ছেন। তাপমাত্রার এই উল্লম্ফন ভয়ের কারণ, সহজেই রোগজীবাণুর আক্রমণ হতে পারে। তাই সাবধানে থাকাই ভাল। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হলে ঠা-া বাড়বেই। তাই রাতে বাসার বাইরে থাকলে সঙ্গে গরম কাপড় রাখাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। জঙ্গীনামা থেমেও থামছে না। ঢাকা জঙ্গীমুক্ত হচ্ছে না, বরং চোখ রাঙাচ্ছে আত্মঘাতী জঙ্গীরা। এবার তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। শুক্র-শনি দুই ছুটির দিনে ঢাকার দু’প্রান্তে দুটি ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি হঠাৎ করেই ঢাকা কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাটে তল্লাশিও বেড়ে গেছে স্বাভাবিক কারণে। কর্তব্যরত পুলিশকে সহযোগিতা করাই সঙ্গত ও সমীচীন। চলতি পথে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে গাড়ি-তল্লাশির ফলে আরোহীর বিরক্তি আসতে পারে, সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। এক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালে কর্তব্য পালনেই সমস্যা সৃষ্টি হবে। ঢাকাবাসী আশা করতেই পারে অচিরেই জঙ্গীদের আরও কিছু পরিকল্পনা নস্যাত করে দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকাবাসীর উৎকণ্ঠা ও ভোগান্তিও নিশ্চয়ই কমে আসবে। চেনা রূপ ও গন্ধ! ক’দিন ঢাকায় ছিলাম না, গিয়েছিলাম সমুদ্র দর্শনে। সড়ক পথে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার পথেই সেদিন ঢাকার আশকোনায় জঙ্গী হামলার খবর জানতে পারলাম। রাত এগারোটায় গুলিস্তান ফ্লাইওভার দিয়ে নিচে নেমে এসে উত্তরমুখী যখন আমাদের গাড়ি, ভাবলাম ঢাকায় বোধহয় গাড়ি কম থাকবে, আত্মঘাতী হামলার একটা প্রতিক্রিয়া হয়ত দেখা না গেলেও অনুভব করা যাবে। আসলে ঢাকার সড়ক কোন সংজ্ঞার ভেতরেই পড়ে না। কখন যানজট হবে, কখন হবে নাÑ এ নিয়ে কোন আগাম ধারণা প্রকাশ রীতিমতো নির্বুদ্ধিতার কাজ। ঢাকায় প্রবেশ করে আমার যা অনুভূতি হলো, বিশ্বাস করি বহু মানুষের মনোভাবই অমনটা হবে। প্রথমত যানবাহনের আধিক্য, সিগনালে অনিশ্চিত সময়ের জন্য প্রতীক্ষা। এ দুটি বিষয় মনের ওপর চাপ ফেলে, অন্তত কেউ যদি গ্রাম, কিংবা পাহাড়ী এলাকা/সমুদ্র সৈকত কিংবা চা-বাগান থেকেও আসেন এই রাজধানীতে। একবার সাত দিন ছিলাম কুলাউড়ার একটি চা-বাগানে। ট্রেন থেকে নেমে ভর সন্ধ্যায় তীব্র হর্নের আওয়াজে মনে হচ্ছিল এখনই চিৎকার শুরু করি চালকদের উদ্দেশে। ভদ্রতাবোধ তা হতে দেয়নি, দুই হাতে কান চেপে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। শব্দ দূষণ কী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া জাগায় সেটিই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। এখন অনেক কিছুই সয়ে গেছে। তবু এবার ঢাকায় ফিরে যানজট আর উচ্চ শব্দের হর্ন সাময়িকভাবে হতবিহ্বল করে তুলল। মধ্যরাতে যারা ঢাকায় চলাচল করেন তারা জানেন একেকটা গম্ভীর দানবের মতো ভারি হয়ে ছুটে চলে সারি সারি ট্রাক, হঠাৎ হঠাৎ গাম্ভীর্য খসে পড়ে, নিনাদ শুরু হয়ে যায় যন্ত্রদানবের, আর তার চোখ দুটো রাগে ফুঁসতে থাকে অপরের দৃষ্টিশক্তি ম্রিয়মান করে দেবার সংকল্পে! ভয় পেলাম লোহার রড নিয়ে খোলা একটি ট্রাকের রাজসিক ভঙ্গিতে চলাচল দেখে। সেদিন একটি ইংরেজী দৈনিকে দেখলাম দিনের বেলাতেই ঢাকার ব্যস্ত সড়কে চলছে লোহার রড উন্মুক্ত ও বিপজ্জনকভাবে বহনকারী ট্রাক। এই শহরে কি কোন ট্রাফিক নিয়মই চলতে দেবে না! প্রেমের অবাক পরিণাম! সব মানুষের জীবনেই কি প্রেম আসে? কেন নয়, মানুষের প্রেমবোধ জাগে। অপর পক্ষের সাড়া পেলে তা প্রথাগত প্রেমের রূপ নিতেও পারে। আর কে না জানে প্রথাগত প্রেম কথাটি কত আপেক্ষিক, প্রতিটি প্রেমই কিছু না কিছু প্রথা ভাঙতে চায়। ভালবেসে যে সাধ মেটে না! কিন্তু প্রেমের পরিণামে হত্যা কিংবা আত্মহত্যা এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। এই নিষ্ঠুর নগরীতে প্রেমের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে নরনারী স্বর্গের সন্ধান পায়। আবার কোন কোন প্রেমের বেলায় জন্ম নেয় ঘাতক! আরিফা ও রবিনের বিয়ে ছিল প্রেমের। প্রেমের মৃত্যু হলে তারা বিয়েবিচ্ছেদ করে। এরপর একজন অন্যের হাতে খুন হয়। অবাক ঘটনা! বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা আরিফুন নেছা আরিফাকে বৃহস্পতিবার প্রকাশ্য দিনের আলোয় তার ফ্ল্যাটের সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হলো। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, হত্যাকারী তার সাবেক স্বামী এবং দু’জনে এক সঙ্গেই বাসার গেটের ভেতরে ঢুকেছিলেন। সাবেক স্ত্রীর পেছনে পেছনে শপিংব্যাগ হাতে ঢুকে ফখরুল ইসলাম রবিন মাত্র কয়েক মিনিটের মাথাতেই তাকে এভাবে ছুরিকাঘাত করবেন, তা কে বুঝতে পেরেছিল? কিন্তু আমরা দেখি, রবিনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর জীবন আশঙ্কায় আরিফা কলাবাগান থানায় জিডি করেছিলেন। আরিফার স্বজনদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, ঘাতক ফখরুল মাদকাসক্ত ছিল। এ কারণেই ছয় মাস আগে আরিফা তাকে ডিভোর্স দেন। তার পরিনাম হবে এত ভয়াবহ! প্রেমিক কী করে খুনী হয়! আত্মঘাতী বৃক্ষবিনাশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যে গাছ কেটে ফেলা হয়। যেমন গত বছর ঠিক এ সময়টাতে চলছিল বৃক্ষ হত্যার মহোৎসব। পয়োনিষ্কাশন লাইন বসানোই শুধু নয়, আজগুবি সব দোহাই দিয়ে গাছ কাটা চলতে দেখেছি আমরা। এমনিতেই ঢাকায় গত দুই দশকে গাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। তার ওপর এভাবে নির্বিচারে গাছ কাটা চললে শহর তার সবুজাভা হারাবে। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সঙ্কটের কথা না হয় থাক, কিন্তু শান্তিময় ছায়া আর তাপহরাবান্ধব যে কমে যাবে, সে কথা আর বলে কী হবে! বৃক্ষহন্তারকদের আমরা থামাব কিভাবে? আমরা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ভেতরের শত গাছ কাটার অজুহাত শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। গাছের জন্য হাসপাতালের দেয়াল দেখা যায় না, তাই হঠাও গাছ। কেউ শুনেছে কোথাও এমন আজগুবি কথা! রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান প্রসঙ্গে আসা যাক। পশ্চিমা দেশের ‘এ্যাডাপ্ট আ রোড’-এর ধরনে গুলশানের ১৪৮টি সড়ক দত্তক নিলেন ১৪৮ জন গুলশানবাসী। প্রতিটি সড়কেই পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেয়া হবে যার বেতন মেটাবেন সংশ্লিষ্ট সড়ক ‘দত্তক’ নেয়া এলাকাবাসী। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তরের মেয়র অনেক অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন এলাকাবাসী ফেসবুকে জানালেন, মেয়র গুলশানে গাছ কাটার কথা স্বীকার করে নাকি বলেছেন, অনেক গাছ তাকে কাটতে/নষ্ট করতে হয়েছে প্রয়োজনে। বললেন গাছ কাটায় রাস্তা নাকি এখন অনেক বড় দেখায়! সে যাই হোক, কাকতালীয়ভাবে ঠিক তার আগের দিন গুলশানবাসী এক সেলিব্রেটি ফেসবুকে এলাকার মুমূর্ষু গাছের ছবি দিলেন। লিখলেন, ‘সবার চোখের সামনে অভিজাত রাস্তার গাছগুলো কি আত্মহনন করল! নাকি হত্যাকা-ের শিকার হলো! নাকি গ্রীন সিটি বানানোর নতুন কোন উদ্যোগ?’ প্রত্যুত্তরে আরেক খ্যাতিমান মজা করে মন্তব্য করলেন, ‘এটা তোর দৃষ্টিভ্রম। গাছ কোন কোন ঋতুতে রং পাল্টায়। আর সব গাছ যে সবুজ হবে এমন কথা নেই।’ শোনা যাক দুজনার আরেকটু আলাপচারিতা। ‘ঠিক! আজকে ডাক্তার দেখাব, তবে রংটা ভাল পাল্টিয়েছে...’ ‘পুনশ্চঃ যা ঘটছে আর ঘটে আমাদের এখানে তা আমাদের মতো বিজ্ঞজনের চোখের সামনেই ঘটছেরে। আমরা শুধুই তাকিয়ে দেখি।’ ‘কারণ আমরা ক্রমশ একা এবং দায়িত্বহীন হয়ে পড়ছি।’ দু’জনের কথোপকথন দেখে তৃতীয় ব্যক্তি মন্তব্য করলেন, ‘বিজ্ঞের মতো তাকিয়ে না থেকে আপনারা কিছু বলেন বা বোঝান। সকলের কথা ওনাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। আপনাদের মতামতের? মূল্য কর্তৃপক্ষ দেন! অগ্রজের একটি পদক্ষেপ আমাদেরও সাহসী এবং দায়িত্ববান করে তোলে।’ নগরে অতিথির গান কলকাতার নামী সঙ্গীতশিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার এর আগেও কয়েকবার ঢাকায় সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। ১৯৯৩ সাল থেকে দূরদর্শনের একজন নিয়মিত শিল্পী তিনি। আইপিটিএ, শিলচরের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। গত সপ্তাহে শিল্পকলা একাডেমিতে শ্রোতাদের তিনি সুরে ভাসালেন। ‘অপার বাংলার গান’ শিরোনামের এ অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন বাংলাদেশে অবস্থানরত শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু ও স্বজনরা। অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক উদীচীর যুগ্ম সম্পাদক সঙ্গীতা ইমামের আমন্ত্রণে সাড়া দেয়া সম্ভব হয়নি ঢাকার বাইরে থাকায়। তবে যারা সেদিন গান শুনতে গেছেন শিল্পকলায় তাদের কয়েকজনের কাছে শুনেছি শিল্পীর গানের প্রশংসা। লোক, রবীন্দ্র, গণসঙ্গীতসহ নানা আঙ্গিকের বৈচিত্র্যপূর্ণ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উপস্থিত দর্শক- শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন শিল্পী। হাসান আরিফের আবৃত্তিসন্ধ্যা শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘মুক্তিযুদ্ধ নিরন্তর’ শীর্ষক একক আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (আইজিসিসি)। আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ। দীর্ঘকাল ধরে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে আবৃত্তি পরিবেশন করছেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এই মার্চে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশ-সচেতনতাকে ভিত্তি করে রচিত কবিতার ডালি নিয়ে দর্শক-শ্রোতার সামনে উপস্থিত হওয়ার একটি ভিন্ন তাৎপর্যও রয়েছে। এ থেকে একজন সংস্কৃতিকর্মীর দায়িত্বশীলতা ও অঙ্গীকারবোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মেলে। সদ্য প্রয়াত লোকসঙ্গীতশিল্পী বন্ধু কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে উৎসর্গ করে তিনি পাঠ করেন দুটি কবিতা। এটি তাঁর সহমর্মিতার পরিচয়। হাসান আরিফের আবৃত্তি পরিবেশনা মানসম্মত এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে বিশেষভাবে যেটা উল্লেখ করা দরকার সেটি হলো তাঁর স্বকীয়তা ও সুপরিকল্পনার দিকটি। বিশেষ কোনো থিমনির্ভর কবিতাবলী থেকে সমধর্মী পঙক্তি নির্বাচন করে বক্তব্যের একটি স্বচ্ছ নান্দনিক মালা গড়েন তিনি। বিষয়কেন্দ্রীক একটি সামগ্রিক শব্দছবি সৃজনের এই কুশলী প্রক্রিয়া দর্শক-হৃদয়ের গভীরেও অনুরণন তোলে। এখানে ভাব ও বয়ানের সারকথাটিই বড় কথা, সেটি কোন্ কবি লিখেছেন, তিন খ্যাতিমান কি খ্যাতিহীন, সেটি বড় বিবেচ্য নয়। তাই সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা-চরণের পাশেই মুখ তোলে একজন নবীনের অনুভূতিগুচ্ছ; বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানের কবিতার সমান্তরালেই অবস্থান নেয় স্বল্পপরিচিত অথচ বিশিষ্ট কবি মুস্তফা আনোয়ারের যোদ্ধা-কণ্ঠস্বরটি। হলি আর্টিজান নিয়ে তারিক সুজাতের মর্মস্পর্শী কবিতা শোনাতেও তিনি ভোলেন না। আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেটি হলো কবিতার উচ্চারণের সঙ্গে সংগীতের সামঞ্জস্যময় মেলবন্ধন। এই আবৃত্তিশিল্পীর গানের গলাটিও কিন্তু বেশ। সব মিলিয়ে তাঁর পরিবেশনা দেশপ্রেমের শিল্পিত আহ্বান, বাঙালির গৌরবগাথার পুনরুল্লেখ এবং সমকালীন স্বদেশের সংগ্রামী মুখাবয়ব অঙ্কন। জয়তু হাসান আরিফ। ১৯ মার্চ ২০১৭ [email protected]
×