ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলায় লেখিকাদের সঙ্গে আলাপচারিতা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১০ মার্চ ২০১৭

বইমেলায় লেখিকাদের সঙ্গে আলাপচারিতা

২০১৭ সালের বইমেলায় নতুন লেখকদের সারিতে নারীরাও তাদের সৃজনশীল সম্ভার নিয়ে দর্শকের কাছে পৌঁছে যায়। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নারীর যে অগ্রযাত্রা, সেভাবে সৃষ্টিযজ্ঞেও তাদের নিরন্তর পথ চলা শৈল্পিক এই অঙ্গনকে নানামাত্রিকে সমৃদ্ধ করেছে। নারীরা তাদের প্রতিভাদীপ্ত সূক্ষ্ম মননের পরিচয় সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের শুরু থেকেই দিতে শুরু করে। প্রসঙ্গত এসে যায় ঠাকুরবাড়ীর স্বর্ণকুমারী দেবীর কথা। যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক হিসেবে প-িত মহলে স্বীকৃতি অর্জন করেন। আর এই শতাব্দীর শেষলগ্নে বেগম রোকেয়ার সৃষ্টি প্রতিভার শুরুটা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। একমাত্র মীর মশাররফ হোসেন ছাড়া কোন মুসলমান পুরুষ লেখক সাহিত্যিক অঙ্গনে সেভাবে সদর্পে বিচরণ করতে পারেননি। সেখানে বেগম রোকেয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেয়ে নারী হিসেবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সাহিত্যিক আন্দোলনে যে ঝড় তোলেন তা আজও বিস্ময়ের সঙ্গে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। ভাই-বোনের সহযোগিতায় মাতৃভাষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেগম রোকেয়া সাহিত্যিক অঙ্গনে দর্পভরে নিজের মতো করে যে পথ তৈরি করলেন সময়ের গতিতে তা আজও অপ্রতিরোধ্য। যে সাহস, উদ্দীপনা আর তেজস্বিতায় সমকালীন সমাজের সমস্ত অপসংস্কারকে আঘাত করলেন সে জায়গায় একেবারে তিনি নিজেই তার নিজের তুলনা। সেই পথপরিক্রমায় বেগম সুফিয়া কামাল কিংবা বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম আজও সময়ের নির্ভীক পথিক। এভাবে সমাজের অগ্রযাত্রায় নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে একইভাবে নতুন নতুন সৃষ্টি বৈচিত্র্যেও অনবদ্যতার প্রমাণ রেখেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত নারী লেখকরা যেমন আপন মর্যাদায় জায়গা করে নিয়েছেন। পাশাপাশি নতুন নতুন নারী লেখকও সৃজন ভা-ারের এই আঙিনায় সফলতার সঙ্গে তাদের আগমনী বার্তা নিয়ে পাঠকদের সামনে হাজির হচ্ছেন। প্রতিবছর বইমেলায় অনেক নতুন বইয়ের প্রকাশ যেমন হয় সেভাবে নারী লেখকদের নতুন সৃষ্টিকর্মও দর্শকের নজরে আসে। ২০১৭ সালেও কিছু নতুন মুখ কিংবা কিছুটা পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত নারী লেখক দর্শনার্থীর সামনে চলে আসে। এদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাদের নতুন লেখা এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে যে আলোচনা হয় তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাদের মধ্যে সুলতানা শাহরিয়া পিউ, সাঈদা, নাঈম, রুখসানা কাজল এবং কাজী তহমিনার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। প্রথমেই যে বইটি নিয়ে কথা বলব তা অনেক কবিতার সংকলন নাম ‘কবিতার কথামালা’। বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটি সম্পাদিত কাব্য-০২’র প্রকাশনায় আছে স্বপ্নিল বেস্ট প্রোফাইল। এই বইয়ের ১৪ কবির লেখা এবং অর্থায়নে কবিতা সংকলনটির আঙ্গিক গোছানো হয়েছে। বেগম সুফিয়া কামালকে উৎসর্গ করা বইটি শুরু করা হয় সুলতানা শাহরিয়া পিউর এগারোটি কবিতা দিয়ে। সাঈদা নাঈম এতে লিখেছেন ছয়টি কবিতা। দুই কবিই আধুনিক গদ্য কবিতার বৈশিষ্ট্যে তাদের কাব্যিক ছন্দকে নির্মাণ করেছেন। কবিতাগুলো সুখপাঠ্য এবং সহজবোধ্য। অন্য একটি গ্রন্থ ছোটগল্প সংকলন ‘নগরে নতুন খবর’। এতে লিখেছেন রুখসানা কাজল, সোহরাব সুমন, পারভিন আক্তার এবং সুলতানা শাহরিয়া পিউ। ছোট গল্পের আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে লেখা গল্পগুলো পাঠকসমাজে আদৃত হবে। এই কামনাই করি। বইটি প্রকাশ করেছে চিত্র প্রদর্শনী, সুলতানা শাহরিয়া পিউ নিয়মিত কবিতাই মূলত লেখেন। ছোটগল্পের আঙিনায়ও তাঁর বিচরণ উল্লেখ করার মতো। মিষ্টিভাষী, সদালাপী পিউ নিজের সম্পর্কে খুব বেশি বলতে চাননি। বরঞ্চ দেশ, সমাজ ও নারীর বর্তমান অবস্থাই তাকে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন করে, ভাবিয়ে তোলে। পিছিয়ে পড়া এবং শৃঙ্খলিত নারী কিভাবে তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতা পেতে পারে, এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে পিউর অভিমত- প্রত্যেক মেয়েকে নিজের মর্যাদা এবং স্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করতে হবে; সেটা তৃণমূল থেকে শুরু করে সমাজের শীর্ষস্থানে বসা নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ সমাজটা এমনভাবে তৈরি যাতে পদে পদে মেয়েদের হোঁচট খেতে হয়। আমরা নিজেরাই নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছি। এখনও নিজের অবস্থানকে শক্ত করার প্রচেষ্টায় লড়াই করতে হয়। তবে শিক্ষা তো মানুষের অনেক অন্ধকার দূর করে দেয়- ফলে শিক্ষিত মেয়েদের পক্ষে আলোর মিছিলে শামিল হওয়া অনেকটা সহজ। তবে মেয়েরা সচেতন হলে, অভিভাবকরা আরও যতœবান হলে বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক আবর্জনা ঝেড়ে ফেলা সম্ভব হবে। এই বাল্যবিয়েই শিক্ষা গ্রহণের সবচেয়ে বড় বাধা। তার আশা, নারীরা পেছনে পড়ে থাকলে দেশ কোনভাবেই আগাবে না। সুতরাং অনিবার্যভাবেই নারীকে সামনের পথে হাঁটতে হবে। সাঈদা খানমÑ আর একজন যিনি লেখালেখির কাজে নিজেকে নিমগ্ন করেছেন। গল্প, উপন্যাস এবং কবিতা বিচিত্র ধরনের সৃজনকর্মে তার বিচরণ। ২০১৬ সালে তার গল্প সংকলন ‘রোদগুলো জীবনের পায়ে পায়ে’ গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। ‘বেহুলা বাংলা’ বইটি প্রকাশ করে। সাঈদা নাঈমের উপন্যাস ‘মেহেরুন্নেসা’ প্রকাশ পায় ২০১৬ সালের অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। স্বপ্নিল বেস্ট প্রোফাইল বইটির প্রকাশক। তাঁর অন্য একটি কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ বালক’ও ২০১৬ সালের বইমেলায় আসে। বাংলা সাহিত্যের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়া সাঈদা নাঈম সবসময় নিজেকে সৃষ্টিশীল সাধনায় নিমগ্ন রাখতে পছন্দ করেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এবং প্রিয়ভাষিনী সাঈদা দেশ, সমাজ, সংস্কার এবং নারী জাতিকে নিয়েও ভাবেন। তিনি চান সৃজনশীলতার অঙ্গনে নারীদের আরও সক্রিয় এবং উদ্যোগী হওয়া জরুরী। শুধু বই লেখা নয়, প্রকাশনা শিল্পেও নারীর অংশগ্রহণ সময়ের দাবি। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং সূচকে নারীর সমান তালে এগিয়ে চলা উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে দেশ পিছিয়ে যেতে পারে। তিনিও মনে করেন নারীদের বর্তমান শৃঙ্খলিত অবস্থা থেকে সমাজ ও নিজের তাগিদে বের হয়ে আসতেই হবে। কারণ, এর কোন বিকল্প নেই। সর্বশক্তি দিয়ে সবাইকে বাল্যবিয়ের মতো অপতৎপরতা রোধ করতে হবে। শিক্ষাকে নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচনায় রেখে আলোকিত পথ খুঁজে নিতে হবে। নিজের অধিকার এবং মর্যাদাকে কোনভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, শক্তি নিয়ে সংহত হতে হবে। নিজের প্রাপ্য নিজেই বুঝে নেয়া জরুরী। সচেতনতার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। নিজেদের সমৃদ্ধ করতে হবে, সৃজন শক্তিতেও বলীয়ান হতে হবে। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নয়, আত্মবিকাশের স্বার্থে নিজের আসন শক্ত আর মজবুত করা বাঞ্ছনীয়। রুখসানা কাজল সাহিত্যের অঙ্গনে অনেকটাই পরিচিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক রুখসানা কাজল মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সম্ভাবনার পথচলায় নিজেকে শামিল করার প্রেরণা পেয়েছেন বিভিন্ন সংঘাত আর সঙ্কট উত্তরণের মধ্য দিয়ে। আর তাই আজও মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐতিহ্য তার লালিত স্বপ্ন, আর সে কারণেই বোধ হয় তার সৃজনক্ষমতাকে নিবেদন করেন সাতচল্লিশের দেশভাগ কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে। সেই বিবেচনাবোধ থেকে লিখে ফেলেন ‘আহা জীবন’ এবং ‘তোমার জন্য মেয়ে’। ২০১৭ সালে তার আর একটি প্রকাশিত গ্রন্থ ‘নুনফল গল্পগুলো’। নামেই বুঝতে কষ্ট হয় না বইটি অনেক গল্পের সমন্বয়। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘জলের অক্ষর’ বইটিও গল্পের সম্ভারে সমৃদ্ধ। তার ‘নুনফল গল্পগুলো’ কলকাতা থেকে রসেবশে প্রকাশনী বের করে। রুখসানা কাজল পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে যান আর্থ-সামাজিক ও নারী সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে। তার নারী বিষয়ক ভাবনাও একটু অন্যমাত্রার। নারীর এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে অন্যদের সাথে তার কোন বিরোধ নেই। কিন্তু ভাবনায় আছে নিজস্ব বোধ আর অভিব্যক্তি। মনে করেন, অনেক মেয়ে না পারলেও একজন মেয়েও যদি নিজেকে তৈরি করে সমাজ-সংসারে জায়গা করে নিতে পারে সেটার মূল্যও তো কোন অংশে কম নয়। একজন একজন করে একদিন হয়ত বেশ কয়েকজনই সামনে চলার অভিযাত্রায় শামিল হবে। সেদিনও খুব বেশি দূরে নয়। তবে আন্তরিকভাবে চান মেয়েরা নিজের চলার পথকে নিষ্কণ্টক করুক, নির্বিঘœ করুক, সর্বোপরি নিরাপদ করুক। দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় মেয়েরা সাহসের সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করে নেবে। এর কোন বিকল্প নেই্ আর এক তরুণ প্রজন্মের লেখক কাজী তাহমিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যে অধ্যাপনা করছেন। বয়সে নবীন। আর সেই কারণে অনেক বেশি প্রাণবন্ত আর উচ্ছল। পারিবারিক নির্মল আবহে অনেকটাই স্বাধীনভাবে বড় হয়েছেন। বিয়ের পরও সেই স্বাধীনতায় কোন বিঘœ ঘটেনি। যার কারণে মা, বাবা এবং স্বামী সবাইকে স্মরণ করেন পরম শ্রদ্ধাভরে। কর্মজীবনের পাশাপাশি সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে পারছেন পারিবারিক সহযোগিতায়। ২০১৭ সালের গ্রন্থমেলায় প্রকাশ পায় তার আত্মকথনমূলক বই ‘অসুখের কাল, সুখের কাল’ (মুহূর্ত কথা)। নিজের অর্থায়নে সিলেটের ‘চৈতন্য’ প্রকাশনা বইটি প্রকাশ করে। মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র নয়। এখানে মেয়েদের অনেক লড়াই করতে হয় পরিবারের সাথে সমাজ সংস্কারের সঙ্গে। বাল্যবিয়ের মতো এক অভিশাপ এদেশের মেয়েদের জীবনকে সর্বনাশের শেষ পর্যায়ে নিয়ে যায়। অপরিণত জীবন সংগ্রামে নামতে হয়, অকাল মাতৃত্বের কশাঘাতে নিষ্পেষিত হতে হয়, সেটাকে অত্যন্ত সচেতনভাবে উত্তরণ করতে না পারলে বালিকারা মানুষের মতো বাঁচার অধিকারটুকুও হারাবে। বয়স অল্প হলেও একজন প্রতিষ্ঠিত নারী হিসেবে এসব ভাবনাও তাকে চিন্তিত করে, ব্যথিত করে। সামনে এসব বিষয় নিয়ে লেখার চিন্তা তার বিবেচনার মধ্যে আছে। মাত্র তো শুরু করা। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। নিজেকে আরও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে আপন মর্যাদায় টিকে থাকতে হবে। সব মিলিয়ে ২০১৭ সালে গ্রন্থমেলা প্রতিষ্ঠিত এবং তরুণ প্রজন্মের নারী লেখকদের পদচারণায় বিশেষ প্রভাব রেখেছে। বিচিত্র সৃষ্টিকর্মে নারীরাও যে সমানতালে সময়ের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তা যেমন জাতির জন্য মঙ্গল, পাশাপাশি নারীদের জন্যও শুভসংকেত। উন্নয়নের কোন ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। সৃজন ক্ষমতা ও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। এবারের গ্রন্থমেলায় নারী লেখকদের নতুন নতুন প্রকাশনা সেই সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়।
×