ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম প্রবন্ধ লেখেন আবদুল হক

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম প্রবন্ধ লেখেন আবদুল হক

আরাফাত মুন্না ॥ ১৯৪৭ সালের শুরুর দিকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ তার অন্তর্ভুক্ত হবে। রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই পশ্চিম অংশের নেতারা এমন মনোভাব প্রকাশ করতে লাগলেন যে, সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে। রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হওয়ার আগে প্রথম এ বিষয়ে সচেতন প্রতিবাদ করেন লেখক-সাহিত্যিকরা। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা করে এর প্রতিবাদ করেছিলেন আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭)। ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন ‘বাংলাভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় দুই পর্বে প্রবন্ধ লিখে রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে এ ধারণার বিরুদ্ধে মননশীলতার দিক থেকে সংগ্রামী ভূমিকার সূচনা ঘটান তিনি। কাছাকাছি সময়ে একই বছরের ৩০ জুন তারিখে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় তিনি লেখেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামের আরেকটি প্রবন্ধ। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দীন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দিলে ২৯ জুলাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বিরোধিতা করে দৈনিক আজাদে ‘পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’ নামে এ বিষয়ে আবদুল হক তৃতীয় প্রবন্ধটি লেখেন ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় আর চতুর্থটি লেখেন মিসেস এম. এ. হক ছদ্মনামে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকার ৩ আগস্ট ১৯৪৭ সংখ্যায়। আবদুল হকের ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব বই থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তার এ বইটি ১৯৭৬ সালে মুক্তধারা প্রকাশনী প্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে আবদুল হকের যে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, ওই প্রবন্ধগুলোই রয়েছে এই বইয়ে। আবদুল হকের মেয়ে আক্তার জাহান জনকণ্ঠকে বলেন, কিশোর বয়স থেকেই আবদুল হক অন্তঃপ্রকৃতির দিক থেকে ছিলেন সাহিত্যিক। তবে সমাজ-রাজনীতি বিষয়ে তার ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি। সামাজিক-রাজনৈতিক যে কোন ঘটনার অন্তর্গত তাৎপর্য তিনি অনুভব করতে পারতেন। তিনি বলেন, তবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে অনেকের নাম এলেও আমার বাবার নামটি সবাই ভুলে যাচ্ছে। বিষয়টি তাকে কষ্ট দেয় বলেও তিনি জানান। ২০১১ সালে আবদুল হক মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন আক্তার জাহান। ‘ভাষা-আন্দোলনের আদিপর্ব’ বইয়ে আবদুল হক লিখেছেন, ‘ভারত-বিভাগ পরিকল্পনা ঘোষণার পর হিসাব করে দেখা গেল পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরাই সংখ্যাগুরু হতে যাচ্ছে। এই বিষয়টি মুসলিম মানসে এক ধরনের আস্থা সৃষ্টি করেছিল। ভাবী রাষ্ট্রের বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে অনেক রোমান্টিক জল্পনা। সে জল্পনার মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের অনেক রঙিন স্বপ্নও মেশানো ছিল।’ বইয়ে তিনি আরও বলেন, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে এ তথ্য পাকিস্তানের রঙিন জল্পনার ওপর প্রথম আঘাত। আবদুল হক এবং তার বন্ধু কবি আবুল হোসেন ও ফররুখ আহমদ মিলে ঠিক করেছিলেন তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে লিখবেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ব্যক্তিগত পর্যায়েও সাহিত্যিক মহলে প্রচার চালাবেন। সে সময়কার তরুণ লেখক মাহবুব জামাল জাহেদীও ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে দৈনিক ইত্তেহাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ওই প্রবন্ধে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকে গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়। ফররুখ আহমদ লিখেছিলেন, আশ্বিন ১৩৫৪ সংখ্যা ‘সওগাত’-এ। ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে সুপারিশ করেন। লেখার দিক থেকে নেতৃত্ব যে আবদুল হকই দিয়েছিলেন তা তার ওই সময়কার লেখা প্রবন্ধগুলো থেকেই অনুমান করা যায়। ওই বইয়ে তিনি আরও লেখেন, নিজের অংশগ্রহণ ছিল বলে এ প্রসঙ্গে দীর্ঘকাল নিশ্চুপ ছিলেন আবদুল হক। কিন্তু পরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চা বেশ বেগবান হয়ে উঠলে তাতে লেখক সমাজের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গটি অনুলিখিত থাকায় এর ‘ঐতিহাসিক মূল্য’ আছে মনে করে নিজ ব্যক্তিত্বের অন্তর্মুখী-অপ্রতিভতা কাটিয়ে এ নিয়ে প্রথমে দুটি প্রবন্ধ ও পরে ছোট্ট একটি বই লিখেছিলেন তিনি। আক্তার জাহান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ভাষা-আন্দোলনের পটভূমি’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ‘বাংলা একাডেমী গবেষণা পত্রিকা’ ১৩৮৯ সালের মাঘ-চৈত্র সংখ্যায় এবং বাংলা ‘বর্ণমালা বিলোপের প্রয়াস : ভাষা-আন্দোলনের এক অধ্যায়’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায়। আবদুল হক ওই দুটি প্রবন্ধ রচনার পরে যারা ভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে লিখেছেন তারা পূর্বোক্ত ১৯৪৭ সালের প্রবন্ধগুলো থেকে কেউ উদ্ধৃতি দেননি। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বাংলা ভাষার দাবি আবদুল হকই প্রথম উত্থাপন করেছিলেন। দৈনিক আজাদে একটি এবং দৈনিক ইত্তেহাদে দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং একই সঙ্গে মিসেস এম. এ. হক নামে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায়ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বাংলা রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে প্রবন্ধগুলো সে সময়ে তিনি লিখেছিলেন একটা প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে। আবদুল হকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ॥ বাংলাদেশের প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সাহিত্যিক এবং ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের’ অন্যতম উত্তরসাধক ‘আবদুল হক’ ১৯১৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের উদয়নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সালে কানসাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (প্রথম বিভাগ) এবং ১৯৩৯ সালে করটিয়ার সাদত কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট (প্রথম বিভাগ) পাস করেন। মেধাবী ছাত্র ‘আবদুল হক’ ১৯৪৪ সালে রাজশাহী সরকারী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক (ইংরেজী) এবং ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ (ইংরেজী) ডিগ্রী অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও ১৯৬৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। প্রবন্ধ, গল্প নাটক ও অনুবাদসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর রচিত অসংখ্য লেখা সেই সময়ের জাতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মূলত তিনি প্রাবন্ধিক হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৮ সালে দাউদ সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেন। তাঁর ‘লেখকের রোজনামচায় চার দশকের রাজনীতি-পরিক্রমা প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ ১৯৫৩-১৯৯৩’ একটি মূল্যবান রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। আবদুল হক মূলত বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও চিন্তক। কাজী আবদুল ওদুদের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের’ অন্যতম উত্তরসাধক ‘আবদুল হকের’ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি। বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ‘আবদুল হক’ ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
×