ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

বিষাদের দিনে পেছন ফিরে দেখা, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বিষাদের দিনে পেছন ফিরে দেখা, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন

মোরসালিন মিজান ॥ আহা কী বেদনার দিন! বিষাদে ডুবে থাকা। একজন লেখককে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হলো। অমর একুশে গ্রন্থমেলার স্টলে তখনও তার নতুন বই। সুন্দর সাজানো। অভিজিত রায় সেসব বইতে নিজের বিশ্বাসের কথা লিখেছিলেন। বিজ্ঞান লেখকের চিন্তার বিপরীতে যারা, লিখলেন না কিছুই। চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। মানুষ হত্যা করল আরেক মানুষকে। অমর একুশের মেলা থেকে ফেরার পথে মুখ থুবড়ে পড়লো মুক্তচিন্তা। ঝড়লো রক্ত। ওইদিন মেলার সব আলো নিভে গেল হঠাৎ করেই। নেমে আসলো ঘোর অন্ধকার। রবিবার ছিল সেই কালিমা মাখা দিন। দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি অনেকেই। ২৬তম দিনে মেলায় আসা মানবিক মানুষের মন ছিল বিষন্ন। পাঠকেরা মেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন। পছন্দের বই সংগ্রহ করেছেন। ব্যস্ততা ছিল দেখার মতো। এর পরও ঘুরে ফিরে এসেছেন অভিজিত। একইভাবে খুন হওয়া প্রকাশক দীপনের কথা হয়েছে। বিকেলে জাগৃতি প্রকাশনীর স্টলের সামনে কথা হলো ইশতিয়াক মাহমুদ নামের এক পাঠকের সঙ্গে। তিনি বললেন, আজকের দিনে একজন লেখককে খুন করা হয়েছিল। আমি এই খুনের প্রতিবাদ করতে এসেছি। আমি অভিজিতের বই কিনে এই প্রতিবাদ জানাতে চাই। কিন্তু মেলার কোন স্টলে তার বই পাইনি। জাগৃতিতে থেকে অন্য লেখকের বই কিনে নিয়ে যাচ্ছি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক পাঠক মনিরুল ইসলাম আলোচনায় যোগ দিয়ে বলেন, অভিজিতের বই প্রকাশের কারণে আক্রান্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বর মেলায় নেই। জাগৃতি কোনরকমে টিকে আছে। এর পরও বলবো, বাংলাদেশ ধর্মব্যবসায়ী বা জঙ্গীদের নয়। এ কারণেই দেখবেন মৌলবাদী জঙ্গীদের আক্রমণের হুংকারের মাঝেও মেলায় লোকসমাগম কমেনি। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। এভাবেই সব ধর্মের, সকল মত পথের বাংলাদেশ টিকে থাকবে বলে মন্তব্য করেন এই ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। বিষাদের দিনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার কথা জানান আরও কয়েকজন পাঠক। একইদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্মরণ করা হয় নিহত লেখককে। তবে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির কথা আলাদা। কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘এ জগতে অবিশ্রম জীবনের প্রবাহ মৃত্যুকে হু হু করিয়া ভাসাইয়া লইয়া যায়, মৃত কোথাও টিঁকিয়া থাকিতে পারে না।’ অভিজিত বাংলা একাডেমিতে সত্যি টিকতে পারেননি। লেখক হত্যার কালো দিবসে যথারীতি নীরব ছিল ‘জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি।’ কারও মুখে কোন রা ছিল না। একুশ মানে মাথা নত না করা। সেই একুশের মেলা তার লেখককে, প্রকাশককে স্মরণ করল না একটিবারের জন্য। এই বেদনার কথাও দিনভর হয়েছে। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে...। এদিনও দৃশ্যমান হয়েছে আনন্দ। এ আনন্দ বই সংগ্রহের। মেলার শেষ সময় হওয়ায়, অধিকাংশ পাঠকক তালিকা ধরে বই কিনেছেন। কুপম-ুকতার বিরুদ্ধে এ-ও তো এক ধরনের প্রতিবাদ! সময় বাড়ল শেষদিনের মেলার ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার সময় কয়েক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। ২৮তম দিনে মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায়। চলবে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। রবিবার মেলায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মেলার পরও নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলা শেষ হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এর পরও নতুন বই সংগ্রহের ভাল সুযোগ থাকছে। কৈশোর তারুণ্যকে বইয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে বিশেষ মেলার আয়োজন করা হবে। রবিবার তেমন উদ্যোগের কথা জানা গেল লেখক প্রকাশকদের এক আড্ডা থেকে। মেলার স্বাধীনতা স্তম্ভ সংলগ্ন খোলা জায়গায় গোল হয়ে বসেছিলেন লেখক ও প্রকাশকরা। বিগত দিনের কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে ‘কৈশোর-তারুণ্যে বই’ শিরোনামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রকাশকদের একটি দল। এরই মাঝে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমের পাশে আয়োজন করা হয়েছে ১১টি গ্রন্থমেলা। একুশের মেলা শেষে আবারও শুরু হবে সেই কার্যক্রম। নির্বাচিত বই ॥ আনিসুজ্জামান সম্পাদিত গ্রন্থ ‘প্রথম শহীদ মিনার ও পিয়ারু সরদার।’ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গ্রন্থে শহীদ মিনার ও পিয়ারু সরদার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা। কবি নাসির আহমেদের ‘কবিতা সংগ্রহ’ প্রকাশ করেছে দি রয়েল পাবলিশার্স। এটি কবির বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতার সংকলন। বিশেষ করে প্রথম দিকে তার লেখা কবিতা এখানে পাওয়া যাবে। প্রখ্যাত কবি আহসান হাবীব ও খ্যাতিমান সাংবাদিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানকে কাব্য গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন নাসির আহমেদ। গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীরের বই ‘পপ গানের সেকাল একাল।’ প্রকাশ করেছে মিজান পাবলিশার্স। বইতে বাংলাদেশে পপ সঙ্গীতের অতীত ও বর্তমান নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন লেখক। নতুন বই ॥ মেলায় এদিন নতুন বই এসেছে ১০৩ টি। আমান-উদ-দৌলার বই ‘পঁচিশ বছর পরে’ মেলায় এনেছে বিদ্যা প্রকাশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাহবাগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয় বইতে উঠে এসেছে। মেলবন্ধন প্রকাশনী থেকে মেলায় এসেছে সুমন্ত গুপ্তের ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য ভ্রমণ।’ বইতে লেখকের নির্বাচিত ভ্রমণ কাহিনী। বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস জীবনধারা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। লিটলম্যাগ চত্বরের ৬২নং স্টলে বইটি পাওয়া যাবে যাচ্ছে। শাহজাহান আবদালী সম্পাদিত ‘পুরুষ যখন নির্যাতিত’ প্রকাশ করেছে গ্রন্থকানন। গৌর চন্দ্র রায়ের ‘কুরুক্ষেত্র থেকে কুরুক্ষেত্র’ প্রকাশ করেছে সুলেখা প্রকাশনী। আবিষ্কার থেকে প্রকাশিত হয়েছে নির্ভানা হকের উপন্যাস ‘সেই মেয়েটি।’ মেলায় সংস্কৃতি মন্ত্রী ॥ অনেকদিন পর মেলায় এসেছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। না, মেলা পরিদর্শন নয়। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে আসা। একাধিক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। একটির কথা বলা যাক। বইয়ের শিরোনাম ‘সান, ফান এ্যান্ড দ্যা সি : দ্য ম্যাজিক অব থাইল্যান্ড।’ প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী। লেখক অমিয় মাজহার। প্রকাশক এবং প্রকাশক নেতা হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি বাবা মাজহারুল ইসলামের। কিন্তু ছেলে অমিয় মাজহার শুরুটা করল লেখক হিসেবে। করল বলার কারণ, এখনও কিশোর সে। এরই মাঝে লিখেছে ভ্রমণকাহিনী। ‘সান, ফান এ্যান্ড দ্যা সি : দ্য ম্যাজিক অব থাইল্যান্ড’ শিরোনামে বইটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। রবিবার মেলায় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এইটুকুন লেখকের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রী! কেন? ব্যাখ্যা করে অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, লেখকের পরিবারের সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। কিন্তু এ সম্পর্কের খাতিরে না, লেখকের টানে এসেছি। কারণ, ওকে জন্মের পর থেকে দেখছি, ওর নামটাও আমার দেয়া। ও এই ছোট্ট বয়সে বই লিখেছে, তাও ভ্রমণকাহিনী। আমি এখনও পড়িনি, তবে নতুন লেখকের শুরু তো হলো। কিশোর লেখককে স্বাগত জানান মন্ত্রী। এ সময় প্রকাশক আলমগীর রহমান, লেককের বাবা মাজহারুল ইসলাম, মা তাজনিনা রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বইটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। বইতে থাইল্যান্ড ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখেছেন অমিয় মাজহার। মূল মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আত্মজীবনীমূলক সাহিত্য’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার উপাচার্য ড. রাশিদ আসকারী। আলোচনা করেন ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী, ড. এ এস এম বোরহান উদ্দীন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বক্তারা বলেন, আত্মজীবনী সাহিত্যরীতি হিসেবে বেশ পুরনো এবং প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত এর ধারাবাহিক প্রচলন অব্যাহত রয়েছে। বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনাকারী অনেক মনীষীই তাদের জীবনকাহিনী লিখে যেতে প্রয়াস পেয়েছেন। তত্ত্ব-বিস্ফোরণের এ যুগে শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো আত্মজীবনী-তত্ত্বও এক বহুল আলোচিত ক্ষেত্র হিসেবে গৃহীত হয়েছে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ইয়াকুব আলী খান, লীনা তাপসী খান, শারমিন সাথী ইসলাম, প্রদীপ কুমার নন্দী, সুমন মজুমদার, মাহবুবা রহমান, ফারহানা শিরিন প্রমুখ।
×