ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের বই

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের বই

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বড় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই।’ এই দৈন্য বুঝি এতদিন পরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলা একাডেমির এবারের বইমেলায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ৬৫টি। শহীদ দিবস ও ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বইয়ের সংখ্যা আরও কম, মাত্র ৯টি। এসব বইয়ের মধ্যেও প্রধানত গল্প-উপন্যাস-কবিতা- শিশুসাহিত্য-চলচ্চিত্র ইত্যাদি। প্রবন্ধ ও ইতিহাসসংক্রান্ত বইয়ের সংখ্যা খুব কম, প্রায় নেই বললেই চলে। সত্য বটে, সাহিত্য চেতনা জাগ্রত ও বিকশিত করে। সেই হিসেবে এর অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বৈকি। তবে দেখতে হবে যে, সেটা যথার্থ অর্থেই সাহিত্য শিল্পরস সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে কিনা। সেটা পাঠকের চেতনা জাগ্রত করতে সহায়তা করে কিনা। তা না হলে এর শিল্পগুণ অবশ্যই ব্যাহত হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলাকে উপলক্ষ করে কয়েক হাজার বই প্রকাশিত হয়ে থাকে। তবে এগুলোর মধ্যে কয়টা শিল্পোত্তীর্ণ ও রসোত্তীর্ণ, সে সম্পর্কে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। অন্যদিকে ইতিহাস উন্মোচন করে থাকে নতুন দিগন্তের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে তেমনি এক গৌরবোজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫২ সালে অথবা তারও আগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই যখন উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। সেই থেকেই জেগে ওঠে বাঙালীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা তথা মুক্তিযুদ্ধের দামামা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির সুবাদে ধাপে ধাপে সেই আন্দোলন ও সংগ্রাম দানা বাঁধতে থাকে। এটাই চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে, যার সার কথা ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তো সেই স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামের ওপর ভাল ও কালোত্তীর্ণ বইয়ের অভাব অদ্যাবধি প্রকট। এটি বড় বেদনাদায়ক বৈকি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি বড় প্রভাব বিস্তারী অংশ অবশ্যই ভাষা আন্দোলন, মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্বাধীনতা পূর্ব ও যুদ্ধকালীন শরণার্থী শিবিরের মানবেতর পরিস্থিতি, যুদ্ধে বিদেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহায়তা-সহযোগিতা, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকা- ইত্যাদি সুবিস্তৃত পরিসরে লেখালেখির যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয় অথচ তরুণ প্রজন্মের জন্য এসব বিষয়ে প্রামাণ্য বই-পুস্তক অপরিহার্য। বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে হলে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভিত্তিক ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট জানা অত্যাবশ্যক। বইমেলায় আগত অধিকাংশ পাঠক ও ক্রেতার মতানুসারে, প্রজন্মের কথা বিবেচনায় রেখে আরও বেশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ লেখা আবশ্যক, যার অভাব এবারের বইমেলায় প্রকট। প্রকাশকদের এসব বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগ দাবি করে পাঠক শ্রেণী। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল, সঠিক ও সটীক তথ্যনির্ভর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস অদ্যাবধি লিখিত হয়নি, এটা বড়ই পরিতাপের বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘এই ইতিহাস কে লিখিবে?’ উত্তরও তিনিই দিয়েছিলেন, ‘তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে।’ সে থেকেই যথাসময়ে বেরিয়ে আসবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। বর্তমানে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। তবে সব সময় যে সরকারী উদ্যোগেই লিখিত হতে হবে ইতিহাস গ্রন্থমালা, তা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প-িতবর্গও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
×