ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভালবাসি সৃষ্টিকে, মানুষকে

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভালবাসি সৃষ্টিকে, মানুষকে

‘..বসন্ত জাগ্রত দ্বারে..।’ প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব বেশ ভালভাবেই প্রতিভাত হয়। মানুষ সাধারণের শত-সহস্র ভুল, প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিরূপ আচরণ-কার্যকলাপের পরেও প্রকৃতি এখানে তার বিচিত্র পরিবর্তনের জানান দিতে ভুল করে না। হেমন্ত পেরিয়ে শীত, তারপর আসে বসন্ত। মাঘের শীত এ বছরে ভাল করে জানান দিতে পারেনি ঠিক, তবে সময়ের আগেই বৃক্ষশাখায় কোকিল যে ডেকেছে। জানিয়ে দিয়েছে বসন্ত এসেছে; ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।’ প্রকৃতির প্রতি মানুষ প্রজাতির এ যাবতকালের বিরূপ-বিরুদ্ধ আচরণের ফলে বায়ুম-লে-আবহাওয়ায় তাপমাত্রার যে উর্ধ্বগতি.. পৌষ-মাঘ মাসের ম্রিয়মাণ সংক্ষিপ্ত পদচারণ হয়ত সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবু যে কোকিল ডাকে বৃক্ষশাখায়, তবু যে ধূসর পাতারা ঝরে-ঝরে যায়, গাছে-গাছে সবুজ পত্রপল্লবে ছেয়ে ওঠে, মাঠে-প্রান্তরে বাগানে-আঙিনায় ফুলে-ফুলে ভরে ওঠে, ছেলে-মেয়েরা, তরুণ-তরুণী-যুবা সকলে মেতে ওঠে উৎসব-আনন্দে। প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ-শোভা আবাহনের মঙ্গল-আশীর্বাদ পৃথিবীর আর কোন প্রান্তে মেলে? আমাদের এই ভূমে প্রচ্যে প্রকৃতিতে সৌন্দর্য এক স্বর্গীয় মায়াভূমি। মায়ের আঁচল তলে সন্তানের যে সুখনীড়, বাংলার শ্যামল-গৌর রূপ বর্ণ-গন্ধে-শোভিত সুষমায় মনকে মাতিয়ে তোলে। ভালবাসতে শেখায়। ঋতুর যে প্রভাব আমাদের মন-প্রাণ শরীরে.. তাতেই তো বুঝে নেই ভালবাসা আসছে। মানুষে-মানুষে, প্রাণীতে-মানুষে, প্রাণে-প্রাণে, নরেতে-নারীতে মনে যে উদযোগ শুরু হয়.. কী করে আর দূরে সরে থাকতে পারে মানুষ? মানবজীবন তো এই ভালবাসারই তরে। আহা বসন্ত তুমি জাগ্রত দ্বারে! জীবনের কী অসীম সুষমা, যৌবন কী অপরূপ সৌরভে মনকে জানান দেয়.. প্রকৃতিতে আজ বসন্ত এসে গেছে। রবি ঠাকুরের- ‘ বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা। বইল প্রাণে দখিন হাওয়া আগুন জ¦ালা। যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ-পাতালে। নাচের তালের ঝংকারে তার আমায় মাতালে।’ ক্যাম্পাসে বিশ^বিদ্যালয়ে রঙের যে ধারা বইছে, ছেলে-মেয়েরা যুগলে দলে-দলে হেসে-হেসে চলেছে.. মনে হয় জীবন তো এই-ই। জীবন সাবলীল আনন্দে ভরপুর, সুন্দর। যৌবনকাল নিজেকে তৈরি করার সময়। শক্তি-সাহস-উদ্যমে এগিয়ে চলার তীর্থ ক্যাম্পাস জীবন। নর-নারীর সম্মিলনে এই যে পৃথিবী মানুষের, যৌবন তো তারই শ্রেষ্ঠ আরাধনার কাল। মুক্তপ্রাণে-মননে, সুস্থ শরীর-মনে মাতৃভূমির যোগ্য সন্তান হয়ে ওঠার কাল। মানুষে-মানুষে, নর-নারীতে সম্প্রীতির বন্ধন রচনার এই যৌবনকালই প্রকৃতির বসন্ত। প্রকৃতির এই ভালবাসায় বেড়ে ওঠা সন্তানের হৃদয়-মনে সংস্কার-কালিমার সুযোগ থাকে না। বিশে^র তাবত সৌন্দর্যে বিচরণের সুযোগ যার, সংকীর্ণ স্বার্থ লোভ-লালসা, দুর্নীতি-অনিয়মের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা তার কমই। ‘যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে, মুক্ত কর হে বন্ধ..’। মানুষকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত উন্মুক্ত কর। সংস্কার-কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এস তরুণ-তরুণী যুবা। ক্ষুদ্র জাতি, গোষ্ঠী, ধর্মগত সীমানা প্রাচীর ভুলে মানবতার পথে.. ফারাজের জয়গান কর হে যৌবন। ধর্ম, জাতি, বর্ণ, বৈষম্য ভুলে সুন্দর দেশ- পৃথিবীর পথে এগিয়ে চল। দেশটা যেমন আজ তোমাদের, দেশটা তেমন তো সকলেরই। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী একযোগে স্বাধীন করেছিল এই দেশ কত ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে.. আজ সেই আমরা ষোল কোটিতে। অফুরান সম্ভাবনা আর প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ আমরা। কত অনায়াসে ফল-মূল, শস্য-সম্পদে ভরে ওঠে আমাদের প্রান্তর। কত উদার আলোকিত দিন আমাদের। প্রত্যেকটি দিন- সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা জগতমাতার অকৃপণ কৃপায় ধন্য আমরা। এত সবের পরেও যদি আমরা মানুষ এই দেশের মাতার- প্রকৃতির শিক্ষা থেকে বিযুক্ত হই, যদি হিংসা-দ্বেষ বিভেদ-বিদ্বেষে আসক্ত হয়ে হানাহানি-কাটাকাটিতে লিপ্ত হই, যদি লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে মাতাকেই করি সন্তানহারা.., তার চেয়ে দুঃখের আর কী থাকে? একটা যে জীবন মানুষের তাকে যদি মানুষের কাজে না লাগাই, লোভী হীন খারাপ লোকজনের প্ররোচনায় ভেদ-বুদ্ধিকেই বড় করে দেখি.., তার চেয়ে অহেতুক আর কী হয়? মানুষ তো সকলে আমরা এক সৃষ্টিকর্তারই সন্তান। বসন্তের এই ক্ষণে মানবাত্মার সেই সর্বতো বোধই জাগরূক হোক আমাদের হৃদয়-মনে। ভালবাসি সৃষ্টিকে, মানুষকে। লেখক : চিকিৎসক ও গল্পকার
×