ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠ্যবইয়ে ভুল ও সাম্প্রদায়িকীকরণের ঘটনায় সংস্কৃতিমন্ত্রী

সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এসব অপকর্ম করেছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এসব অপকর্ম করেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পাঠ্যবইয়ে ভুল ও সাম্প্রদায়িকীকরণের ঘটনায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিবাদের মধ্যে এবার একে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেছেন, পাঠ্যপুস্তকে ভুল এবং সংযোজন বিয়োজন অমার্জনীয় অপরাধ। সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ‘অত্যন্ত সুকৌশলে এসব অপকর্ম করছে। এদিকে সাম্প্রদায়িক ও ভুলে ভরা পাঠ্যবই প্রত্যাহারসহ ৮ দফা দাবিতে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠন। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। প্রতিবাদ জানানো হয়েছে আলোচনা সভাতেও। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর গে-ারিয়ায় দীনানাথ সেন রোডের সীমান্ত গ্রন্থাগারের ৬৫ বছর এবং সীমান্ত খেলাঘর আসরের ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘নব আনন্দে জাগো’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে পাঠ্যবই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ‘অত্যন্ত সুকৌশলে এসব অপকর্ম করছে। এরা অর্থনীতি সমাজনীতি রাজনীতিসহ নীতি নির্ধারণী বিষয়গুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে। এদের বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে পাঠাভ্যাস আশানুরূপভাবে গড়ে না উঠায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, শিল্প সংস্কৃতির চর্চা ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি ছাড়া মানবিক সমাজ গড়ে উঠবে না। কিন্তু আমাদের শিশুরা শুধু বইয়ের পাতায় মুখ গুজে পড়ে থাকে। তাদের জীবনে ফুল পাখি নদী আকাশ শিল্প সংস্কৃতি নেই। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে তিনি অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সবাইকে বিশেষ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। সীমান্ত গ্রন্থাগারের সভাপতি মোরশেদ আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, দৈনিক সমকালের সম্পাদক ও সীমান্ত খেলাঘরের সাবেক সভাপতি গোলাম সারওয়ার। প্রতিবাদ কর্মসূচী, স্মারকলিপি এদিকে পাঠ্যবইকে সহজ পাঠের নামে ‘সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক’ বিষয় অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। হাইকোর্টের মাজার গেট সংলগ্ন রাস্তা ও সচিবালয়ের সামনে বাধার মুখে স্মারকলিপি দিয়ে কর্মসূচী শেষ করেন সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে আহতের ঘটনাও ঘটেছে বলে সংগঠনগুলো দাবি করেছে। পুলিশ মন্ত্রণালয়ে যেতে বাধা দেয়ায় পরে ড. সফিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল একটি স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে অবিলম্বে বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক বিষয় পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে ফেলার দাবিসহ আট দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে বাংলা একাডেমির বানানের যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে তা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে তুলেছেন দাবি করে স্মারকলিপিতে বলা হয়, সৃষ্টিশীল সাহিত্য ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে এই অসামঞ্জস্যতা দূর করে একটি স্থিতিশীল বানান কাঠামো প্রণয়ন জরুরী। দেশকে ধ্বংস করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করলেই চলে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিশিষ্ট নাগরিকরা উদ্যোগ প্রকাশ করে বলেছেন, যে হেফাজতে ইসলাম এই সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল এবং খালেদা জিয়া যেখানে সহায়তা করেছিলেন, সেই হেফাজতের কথায় আজকে পাঠ্যপুস্তক বদলাচ্ছে। দলমত-নির্বিশেষ সবাইকে এর প্রতিবাদ করা উচিত। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশ গড়তে অসাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তকের কোন বিকল্প নেই। একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে এর শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করলেই চলে। সেই কাজটিই এখন হচ্ছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পশ্চাদমুখী করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনার সমালোচনা করে এ অভিযোগ করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সভায় তাঁরা বলেন, দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর পরিণতি হবে ভয়ংকর। ‘বাংলাদেশের শিক্ষাধারার গতি-প্রকৃতি’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এ এন রাশেদা। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের পর থেকেই শিক্ষাব্যবস্থাকে পশ্চাদমুখী করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠলেও হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী বলেছেন, দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। অথচ ২০১৭ সালে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে, সেগুলো বেদনদায়ক। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এমন পরিস্থিতিতে আমরা কি এখন বিষয়টি আলোচনা করেই শেষ করব, নাকি সরকারের কাছে এই দাবি জানাব, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশ গড়তে অসাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক চাই। এ এন রাশেদা আরও বলেন, দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার দুরবস্থা চলছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় এখন অধিক মনোযোগ সরকারের। মাদ্রাসা পরিচালনায় কোন নীতিমালা নেই। মাদ্রাসা উন্নয়নের নামে অপচয় হচ্ছে। শিক্ষাধারায় দুর্নীতি ঢুকে যাচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণ চলছে। ২০০৫ সালের সচিবালয় বা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো বহাল তবিয়তে রয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য নেতা হায়দার আকবর খান রনো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশ আবার পাকিস্তানীকরণের দিকে যাচ্ছে। আবারও রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। যে হেফাজতে ইসলাম এই সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল এবং খালেদা জিয়া যেখানে সহায়তা করেছিলেন, সেই হেফাজতের কথায় আজকে পাঠ্যপুস্তক বদলাচ্ছে। দলমত-নির্বিশেষ সবাইকে এর প্রতিবাদ করা উচিত। ভাষাসৈনিক শরীফা খাতুন বলেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যে বীজ বপন করা হয়েছিল, সেটি আজ মহিরুহে পরিণত হয়েছে। জাতিকে ঠিক করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। এ জন্য বোধহয় আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, পাঠ্যপুস্তকের ভুলসহ অন্যান্য সমস্যার জন্য আলাদা করে কর্মসূচী নেয়া উচিত। চরম অদক্ষ, চরম দুর্নীতিবাজ লোকদের হাতে পড়েছে বলেই পাঠ্যপুস্তকের আজ এই সমস্যা। প্রতিবাদ চট্টগ্রামেও, স্মারকলিপি সাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমূলক ও ভুলে ভরা পাঠ্যবই প্রত্যাহারসহ ৮ দফা দাবিতে চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। এতে চরমোনাই পীরের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। প্রগতিশীল গণসংগঠনসমূহের ব্যানারে সকালে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী এবং খেলাঘর যৌথভাবে এই স্মারকলিপি দিয়েছে। এ সময় গণসংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক সামশুল আরেফিন প্রগতিশীল গণসংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। আট দফা স্মারকলিপির মধ্যে সাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমূলক ও ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক অবিলম্বে প্রত্যাহারের বিষয়টি উল্লেখ আছে। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি তোষণ বন্ধ করে বাহাত্তরের সংবিধানের চেতনায় মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন বিশ্বজনীন মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, এস ওয়াজেদ আলী, হুমায়ুন আজাদসহ যেসব লেখকদের লেখাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলো সংযোজনের দাবি জানানো হয়েছে। স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। একটি স্থিতিশীল বানান কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ গণমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ্যবই প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে স্মারকলিপিতে। এছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের হুমকি দেয়ায় চরমোনাই পীরের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে স্মারকলিপিতে। বলা হয়, সরকার নিজেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাবিরোধী বলে ঘোষণা করলেও পাঠ্যবইয়ে তার প্রতিফলন নেই। পাঠ্যবই স্ববিরোধিতায় ভরা।
×