ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের ওপর বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ ;###;১২ দিন অবস্থান শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ;###;ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে আসছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত

কৌশল সময়ক্ষেপণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

কৌশল সময়ক্ষেপণ

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে মিয়ানমার। এই সম্যসার দ্রুত সমাধানের দিকে যেতে আগ্রহী নয় দেশটি। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে দেশটির আন্তরিকতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে শনিবার রাতে ঢাকায় এসেছেন রাখাইন প্রদেশের সঙ্কট নিরসনে গঠিত কফি আনান কমিশনের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এছাড়া আগামী মাসে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে আসছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাও সোচ্চার হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে মিয়ানমারের প্রতি চাপ দিয়েছে। মালয়েশিয়ায় ইতোমধ্যেই ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) জরুরী বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি মিয়ানমারে ১২ দিন অবস্থানের পর সংস্থাটি একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। তবে সেই চাপ উপেক্ষা করে সময়ক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করেছে মিয়ানমার। সিঙ্গাপুরের আসিয়ান সিকিউরিটি ফোরামের বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সময় চেয়েছে মিয়ানমার। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মিয়ানমারের উপ প্রতিরক্ষা প্রধান রিয়ার এ্যাডমিরাল মিন্ট নোয়ে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সঙ্কট ও সমস্যা নিয়ে তার সরকার পুরোপুরি অবহিত রয়েছে। সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান ও অপরাধীদের শাস্তি দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই এই সঙ্কট নিরসনে সময় প্রয়োজন। এছাড়া মিয়ানমারের বিশেষ দূত ও দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ইউ কিও তিন ঢাকা সফর শেষে ফিরে যাওয়ার পরে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা নাগরিকদের নাগরিকত্ব যাচাই বাছাই করে সুবিধাজনক সময়ে ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার। আর শুধুমাত্র রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেননি, দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের বিশেষ দূত বাংলাদেশে এসেছিলেন। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, মিয়ানমার থেকে যদি কোন নাগরিক সেখানে গিয়ে থাকে যাচাই বাছাই করে সুবিধামতো সময়ে ফেরত নিয়ে আসব। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের বিশেষ দূতের ঢাকা সফরের পর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমার আন্তরিক নয়। এছাড়া বার বার নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অজুহাত দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সময়ক্ষেপণ করে চলেছে মিয়ানমার। এছাড়া সিঙ্গাপুরে আসিয়ান সিকিউরিটির ফোরামের বৈঠকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও সমস্যা সমাধানে সময় চাওয়া হয়। মিয়ানমারের এসব পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে মিয়ানমার সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও সমর্থন চেয়েছিল বাংলাদেশ। এই সমস্যা দ্রুত সমাধানে মিয়ানমারকে আন্তজার্তিকভাবে চাপ দেয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছিল সরকার। কেননা বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ দিলে, এ সমস্যার সমাধান মিলতে পারে। সে কারণে বাংলাদেশ চেয়েছিল, বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে মিয়ানমারকে চাপ দিক। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকার বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে মিয়ানমার পরিস্থিতিও তুলে ধরে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। সেই চাপ এখওন অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞের ঘটনায় ইতোমধ্যেই মিয়ানমার সফর করেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। তিনি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থা পরিদর্শন করেছেন। সে সময় কফি আনান সেখানকার উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের বিক্ষোভের মুখেও পড়েন। কফি আনানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা কমিশনের সদস্যরা এবার বাংলাদেশে আসছেন। কফি আনান কমিশনের নয়জন সদস্য রয়েছেন। তবে এদের মধ্যে থেকে তিনজন প্রতিনিধি শনিবার রাতে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। আজ রবি ও সোমবার তারা কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। এরপর আগামী মঙ্গলবার ঢাকায় বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আসছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। তিনি গত ২০ জানুয়ারি মিয়ানমারে ১২ দিনের সফর শেষ করেছেন। সফর শেষে তিনি জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের নির্বাচিত নতুন সরকারকে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া সেদেশের সেনাবাহিনীকে অবশ্যই সেদেশের আইন মেনে এবং মানবাধিকার রক্ষা করে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কোনভাবেই যেন রোহিঙ্গাদের ওপর আইনবহির্ভূত হত্যাকা- না হয় সেদিকে খেয়াল রাখারও আহ্বান জানান তিনি। ইয়াংহি লি এবার বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবেন। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় সেদেশের নয় সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২শ’র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ওই সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করে তারা। নির্যাতন ও দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ প্রেক্ষাপটে সীমান্তে বাড়তি বিজিবি মোতায়েন করা হয়। তবে অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে নতুন করে ৬৬ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন। উল্লেখ্য, তিন দশক ধরে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহনকারী বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী নিতে নারাজ। বার বার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগও নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এই শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
×