ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেশ থেকে মালয়েশিয়া, দশ লাখের বেশি কর্মী দালাল জালে আটক

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

দেশ থেকে মালয়েশিয়া, দশ লাখের বেশি কর্মী দালাল জালে আটক

ফিরোজ মান্না, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে ॥ দশ লাখের বেশি অবৈধ কর্মী দালাল জালে আটকা। দেশ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া পর্যন্ত কোথাও মুক্তি মেলেনি তাদের। ঘাটে ঘাটে রয়েছে দালাল চক্রের থাবা। বৈধ হওয়া ও মালিকের কাছে কাজ পাওয়া, সব জায়গাতেই দালালকে টাকা দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে কর্মীদের। দ্বিতীয় দফায় মালয়েশিয়ায় কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ ঘোষণার কথা শুনেই ১০ হাজারের বেশি দালাল মিলে গড়ে তুলেছে ভয়ঙ্কর চক্র। তারা কর্মীদের বৈধ করে দেয়ার নামে ৫ থেকে ৮ হাজার রিঙ্গিত জনপ্রতি নিচ্ছে। যদিও বৈধ হতে ১২শ’ রিঙ্গিত জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়। আগামী মাসেই দ্বিতীয় দফায় অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার ঘোষণা দিতে পারে মালয়েশিয়া সরকার। এদিকে, ঢাকায় মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের সিন্ডিকেট গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে রিট পিটিশনকারী তার আবেদন তুলে নিয়েছেন। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহিদুল ইসলাম বলেন, অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দেন দরবার করা হচ্ছে। সরকার এক বছরের জন্য কর্মীদের সময় বেঁধে দিয়েছিল। সেই সময় সীমা পার হয়ে যাচ্ছে এ মাসেই। এবার মালয়েশিয়া সরকারের কাছে আমরা দ্বিতীয় দফায় সুযোগ চেয়েছি। এটা যে শুধু বাংলাদেশের কর্মীদের ক্ষেত্রে তা নয়। বিভিন্ন দেশ থেকেই তাদের কর্মীদের জন্য এমন অনুরোধ জানিয়েছেন। মুশকিল হচ্ছে সরকার বৈধ করার সুযোগ দিলেও কর্মীদেরই আগ্রহ কম থাকে বৈধ হওয়ার। তারা হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে চায় না। কেন তারা আসতে চায় না এই বিষয়টি নিয়ে হাইকমিশনের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এর একটা কারণ হচ্ছে হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে এমন ভয় থেকে, অন্য একটি কারণ হচ্ছে দালালরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বৈধ করার। সব দায়িত্ব তারা দালালদের হাতেই ছেড়ে দেন। পরে যখন সময় শেষ হওয়ার পথে তখন দেখেন দালালরা তাদের বৈধ করতে পারেনি। কাজটা নিজের এখানে কোন দালাল দিয়ে নিজের কাজ করা যাবে না। কর্মীরা আসবে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে আবেদন করবেন তারপরই কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে বৈধ হবেন। গত কয়েকদিন মালয়েশিয়ায় ঘুরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী দালালের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা রীতিমতো নিজেদের নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে প্রকাশ্যে দালালি ব্যবসা করছেন। তাদের এক জনের নাম হাবিব। তিনি ৫শ’ জন বাংলাদেশী অবৈধ কর্মীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তাদের বৈধ করে দেয়ার জন্য। এ পর্যন্ত কোন কর্মীকে বৈধ করতে পারেননি। কর্মীদের টাকাও ফেরত দেননি। কর্মীরা তাকে তাগাদা দিলেও হাবিব কোন কর্ণপাত করছেন না। উল্টো কর্মীদের পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন। যদি কারও কাছে এ নিয়ে কথা বলে কেউ তাহলে পুলিশের কাছে জানিয়ে দেবে। অথবা যে মালিকের অধীনে কাজ করে সেই মালিককে জানিয়ে দেয়া হবে। এভাবে দালালের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে অবৈধ কর্মীদের। অবৈধ কর্মীদের ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হচ্ছে। একদিকে মালিক তাদের অর্ধেক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে দালালদের প্রতিমাসে টাকা দিতে হচ্ছে থানায় টাকা দেয়ার নামে। আবার বৈধতার নামে টাকা নিচ্ছে। সারা মাস হারভাঙ্গা খাটুনি খেটে মাস শেষে নিজে খেয়ে পড়ে বাঁচতেই কষ্ট হচ্ছে অবৈধ কর্মীদের। মানবেতর জীবন কাটিয়ে বহু কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ ঋণ পরিশোধের আত্মহত্যার মতো কঠিন পথও বেছে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশী দালাল দেশটিতে কর্মী কিনছে আর বিক্রি করছে। তারা যে যেভাবে পারে সেভাবেই কর্মীদের শোষণ করছে। কখনও হাইকমিশনের নামে, কখনও পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে দেয়ার নামে আবার কখনও বৈধ করে দেয়ার নামে। কর্মীরা কোনভাবেই মুক্তি পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। কর্মীরা বাধ্য হচ্ছে দালালদের কথা মতো চলতে। অথচ ওই কর্মী নিজ উদ্যোগে বৈধ হওয়ার আবেদন করত তাহলে তাকে ১২শ’ রিঙ্গিত জমা দিতে হতো। দালালদের তারা ৫ থেকে ৮ হাজার রিঙ্গিত দিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য নিশ্চিত মনে বসে আছে। এই দালালরা আর কেউ নন তারা বাংলাদেশেরই মানুষ। তারাও একদিন কর্মী হিসেবে দেশটি কাজ করতে এসেছিলেন। দীর্ঘদিন দেশটিতে বসবাস করে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এমনকি তাদের পুলিশের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জানা গেছে, দ্বিতীয় বারের মতো মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার জন্য সুযোগ দিবে। বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০ লাখ কর্মী অবৈধভাবে দেশটিতে কাজ করছেন। হাইকমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের ২ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি অবৈধ কর্মী রয়েছে। যদিও এ সংখ্য ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে ২০ লাখ অনিবন্ধিত বিদেশী কর্মী রয়েছেন। বেশিরভাগ মালিকই চান এসব কর্মী কাজ করুক। মালিকদের এই চাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার ঘোষণা দিতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া সরকার। এদিকে, ঘোষণার আগেই দেশটিতে অবৈধ কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন পুলিশী অভিযান চলছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বুকিত বিনতান এলাকায় স্থানীয় সময় রাত দশটার দিকে অভিযান শুরু হয়। বেশ কিছু কর্মী রসনা বিলাস নামের খাবার হোটেলে রাতের খাবার খাচ্ছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে যে যার মতো খাবার দাবার ফেলে পালিয়ে যায়। দু’ একজন বৈধ কর্মী পুলিশের অভিযান চলা কালেও বসে খাচ্ছিল। তাদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। পুলিশ কর্মী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কাউকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার কাউকে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ওই কর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, মালয়েশিয়ার পুলিশ আগে ঘুষ খেত না। বাংলাদেশী দালালরাই তাদের ঘুষ খাওয়া শিখিয়েছে। তাদের টাকা নেয়ার পথ দেখিয়েছে। আগে এমন অভিযানও চলত না। এখন ঘন ঘন অভিযান চলে। অভিযান চালালেই টাকা পাওয়া যায়। এ দায় মালয়েশিয়ার নয়, এ দায় বাংলাদেশী দালালদের। তাদের কারণে আজ বাংলাদেশী কর্মীদের প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। রিট আবেদন প্রত্যাহার ॥ বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে স্বাক্ষরিত এমওইউ অনুযায়ী কর্মী পাঠানোর কার্যক্রম শীঘ্রই শুরু হতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পর কর্মী নিয়োগের জন্য আধুনিক সফটওয়্যার ডেভেলপসহ অনলাইন পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে সিন্ডিকেট গঠনের অভিযোগ এনে ১৫৩৫৯/২০১৬ নম্বরে দায়ের করা রিট পিটিশনটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে রিট আবেদনকারী ইউনাইটেড এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস.এম. রফিক। গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে রিট আবেদনকারী এস.এম রফিক বলেন, ওবায়দুল আরিফসহ বায়রার ভাল কাজের বিরোধিতাকারী কয়েকজনের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে আমি বায়রার মহাসচিব মোঃ রুহুল আমিন স্বপনকে তার পদ থেকে অপসারণসহ সিন্ডিকেটের হোতা বলে উল্লেখ করি। আমি কতিপয় ব্যক্তির অপপ্রচারণার শিকার হয়ে রিট করেছি বিধায় গত ৫ জানুয়ারি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে রিট পিটিশনে শপথনাম হাইকোর্টে দাখিল করলে হাইকোর্ট আমার রিট পিটিশনটি প্রত্যাহার করে নেয়। সংবাদ সম্মেলনে রিট আবেদনকারী এস এম রফিক আরও বলেন, বায়রার মহাসচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক রিট পিটিশন দায়ের করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের জন্য যে অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হতে যাচ্ছে এতে সিন্ডিকেটের কোন সুযোগ নেই। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বায়রার সকল সদস্য সচেতন থেকে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারকে সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের এই বৃহৎ শ্রমবাজার সহায়ক ভূমিকা রাখবেন।
×