ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ

সততা যখন প্রায় নির্বাসনে যেতে বসেছে সে সময় দুয়েকটি সততার দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে কিছুটা হলেও আলোড়ন তোলে। এসব থেকে হয়ত খুব বেশি মানুষ শিক্ষা নেন না, কিংবা নিজ জীবনে সেটা অনুসরণ করেন না। তবু তার মূল্য অনেক। মানুষ হিসেবে মানুষের পরিচয় ও মূল্যের ওই বড় জায়গাটি বিবেকে এসে করাঘাত করে। রিক্সা কিংবা সিএনজি অটোরিক্সা যাত্রী যান থেকে নেমে যাওয়ার সময় বড় অঙ্কের টাকা ফেলে গেলে চালক যদি খুঁজে খুঁজে ওই যাত্রীর হাতে সেটি পৌঁছে দেন, তাহলে এই ঘটনা সংবাদ হয়ে ওঠে। মানুষও আগ্রহ ভরে সেই সংবাদ পাঠ করে থাকেন। এ থেকে সমাজের হৃদস্পন্দন আঁচ করা যায়। যাত্রী যানবাহনে টাকা ফেলে গেলে সেটির ওপর চালকের অধিকার জন্মায় না। বহু চালক হয়ত আবার সেই অর্থ আত্মসাত করে থাকেন। দুয়েকজন সেটি গ্রহণে অপারগ হন এবং সেই টাকা মালিকের হাতে না পৌঁছনো পর্যন্ত তার ঘুম হারাম হয়ে যায়। এই যে দুটি বিপরীত চিত্র- এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ ও মূল্যবোধের বিষয়টি। পেশাগত দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ নিয়ে নানা ধরনের দৃষ্টান্ত বিরাজ করছে সমাজে। পথেঘাটে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে না এসে তাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে যাওয়া অথবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি বা সেলফি তোলার এক নির্মম রেওয়াজ শুরু হয়েছে আজকাল। এমন একটি হতাশাজনক বাস্তবতার ভেতর ব্যতিক্রম অথচ সেটাই সঙ্গত ও স্বাভাবিকÑ এমন কিছু উদাহরণ সৃষ্টি হলে তা সমাজে গভীর প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। রেলওয়ে বিভাগের একজন গেটম্যান এমন দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন সম্প্রতি। গত ২১ নবেম্বর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের চাষাঢ়া রেলগেট সংলগ্ন রেললাইনে আত্মহত্যার জন্য শুয়ে পড়ে এক যুবক। সে সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাইনে শুয়ে থাকা যুবককে বাঁচান গেটম্যান বিল্লাল হোসেন মজুমদার। দ্রুত বেগে আসা ট্রেনটি তখন ওই যুবকের কয়েক ফুট দূরে ছিল, বিবেকের দায় উপেক্ষা করতে পারেন নি বিল্লাল। জীবনের ঝুঁকি মানুষ সহজে নিতে চায় না। সামান্য কর্তব্যকর্মেও তার কত অনীহা! সেখানে বিল্লালের এই দায়িত্ববোধ প্রশংসাযোগ্য। রেল মন্ত্রণালয় থেকে তাকে সম্মাননা জানানোর উদ্যোগটিও সাধুবাদযোগ্য। গেটম্যান নিজেই সাংবাদিকের কাছে বলেছেন, এটি তার পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। মানুষের জীবন বাঁচানোর চাইতে বড় মানবিক কাজ আর কী হতে পারে? একজন গেটম্যান তার চোখের সামনে জলজ্যান্ত এক যুবকের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। তিনি তৎপর হয়েছেন যুবকটির জীবন বাঁচাতে। এতে প্রমাণিত হয় মানুষের মধ্যে এখনও মমতা ও মানবতাবোধ জাগরূক রয়েছে। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে- এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। আত্মহত্যা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না এই সমাজেরই কোন না কোন বিরূপতা, পরিবারের কোন না কোন আঘাত একজন মানুষকে চরম হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। তাকে ঠেলে দেয় আত্মহননের মতো চরম পন্থার দিকে। অথচ বিপদাপন্ন, হতাশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সামান্য সান্ত¡নাবাণীর উচ্চারণই অনেক সময় নিমজ্জমান মানুষকে অভয় ও শক্তি যোগাতে পারে। জীবন অনেক মূল্যবান, তাকে রক্ষা করা ও ইতিবাচক পথে পরিচালিত করাই তার সার্থকতা। আজকের দিনে বিল্লালের মতো সাহসী ও পরোপকারী কর্তব্যপরায়ণ অনেক মানুষের দরকার এই সমাজে। খাদের কিনার থেকে বিপন্ন মানুষকে টেনে তোলার জন্য হাজার হাজার হৃদয়বান দায়িত্বশীল মানুষ চাই।
×