ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর বিমানে ত্রুটি ॥ ফাঁসছেন তিন প্রকৌশলী

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

প্রধানমন্ত্রীর বিমানে ত্রুটি ॥ ফাঁসছেন তিন প্রকৌশলী

আজাদ সুলায়মান ॥ পরপর চার দফায় গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া এক পাইলটকেও এবার প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের ভিভিআইপি ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ আছে, নানা তদবির করে তার জন্য গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্সও যোগাড় করেছে বিমান। ক্লিয়ারেন্স পেতে বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজার ও একজন বোর্ড মেম্বারকে ব্যবহার করা হয়েছিল। জানা গেছে, ২০০৭ সালের আগে বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল না তখন ওই পাইলট সাবেক এক প্রধানমন্ত্রীর ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনা করতেন। এ কারণে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সব ধরনের ভিভিআইপি ফ্লাইট থেকে তাকে বাদ রাখা হয়েছিল। একাধিকবার তাকে ভিভিআইপি ফ্লাইটে পাঠানোর জন্য বিমান থেকে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স চেয়েও পায়নি। কিন্তু এবার হঠাৎ করে কিভাবে তাকে ভিভিআইপি ফ্লাইটে রাখা হলো তা রহস্যজনক। এদিকে হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে তুর্কিমেনিস্তানে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের ফ্লাইট রাঙ্গাপ্রভাত জরুরী অবতরণের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন প্রকৌশল বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ তিনজন প্রকৌশলী। আজ বুধবার এ ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট পেশ করার পর তাদের বরখাস্ত করা হতে পারে। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন নিজেই তদন্তের আগে-পরের সার্বিক পরিস্থিতি গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। অতীতের ন্যায় এবার যাতে তদন্তের নামে কোন ধরনের আইওয়াশ না হয় সেটা নিশ্চিত করতে তিনি মঙ্গলবারও নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। বিমান পর্ষদের সভায় এ ঘটনায় উপস্থিত সব সদস্য চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা এ বিষয়ে জানার জন্য প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামানের কাছ থেকে প্রকৃত ব্যাখ্যা তলব করেন। আসাদুজামান সেখানে উপস্থিত হয়ে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ দেন। পর্ষদ বৈঠকে এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের আজ বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ফেরার আগেই কয়েকজনকে শাস্তি দেয়ার সুপারিশ করা হয়। এদিকে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়া সেই উড়োজাহাজ রাঙ্গাপ্রভাত তদন্তের জন্য একদিন হ্যাঙ্গারে জব্দ রাখার পর মঙ্গলবার রাতে সৌদির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছে। তদন্তকারীরা রাঙ্গাপ্রভাত থেকে ডিএফডিআর (ভয়েস রেকর্ডিং যন্ত্র) খুলে নিয়ে রেকর্ড করা ককপিটের সব কথোপকথন কপি করেছে। মঙ্গলবার সেটা পুনঃসংযোজন করার পর রাঙ্গাপ্রভাত রাতেই জেদ্দার উদ্দেশে আকাশে ওড়ে। অন্যদিকে বিমানের বোয়িং ৭৭৭ আকাশ প্রদীপ যাত্রী নিয়ে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে জেদ্দা যায়। সেখান থেকে বুদাপেস্টে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আজ রাত এগারোটায় ঢাকা ফিরবে বলে জানিয়েছে বিমান সূত্র। তদন্ত কমিটির এক সদস্য জনকণ্ঠকে বলেন, রাঙ্গাপ্রভাতের ভয়েস রেকর্ডে যান্ত্রিক ত্রুটির আগে-পরে ককপিটে বসে ক্যাপ্টেন, ফার্স্ট অফিসার কী ধররের কথাবার্তা বলেছেন, কখন কোন্ পরিস্থিতিতে অয়েল প্রেসার ইন্ডিকেট পেয়েছেন, তার কত সময় পর জরুরী অবতরণের ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্তকারীরা এখন ভয়েস রেকর্ডিংয়ে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন- অয়েল প্রেসার লো হওয়ার কারণেই রাঙ্গাপ্রভাতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এখন এর দায়ভার কার ওপর কতটুকু চাপানো যায় সেটাই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে একজন সদস্য বলেন, এ বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ভিভিআইপি ফ্লাইট হিসেবে ডিক্লেয়ার করার পর থেকেই বিশেষ প্রহরায় থাকে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ওই অবস্থায় একক কোন ব্যক্তির পক্ষে কোন সাবোট্যাজ কতটুকু করা সম্ভব সেটাই দেখার বিষয়। তিনি বলেন, এখনও পর্যন্ত এ ঘটনায় কারোর বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে উপরের নির্দেশ রয়েছে- প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট পেশ করার পরপরই যেন অন্তত দু-চারজনকে শাস্তি দেয়া হয়। এজন্য বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে মৌখিকভাবে নির্দেশও দেয়া হয়েছে। তোলপাড় করা এ ঘটনায় বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মঙ্গলবারও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এ ঘটনায় তিনি নিজেই তদারকি করছেন, যাতে এবার অতীতের মতো আইনের কোন ফাঁক-ফোকরে দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে না যায়। এজন্য তিনি মঙ্গলবার সিভিল এ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরীর সঙ্গে নিজ অফিসে ডেকে কথা বলেছেন। এ সময় এর আগে শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েতে ধাতব বস্তু পড়ে থাকার তদন্ত রিপোর্টের বিষয়বস্তু ও দায়ী ব্যক্তিদের কী ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে সেটা জানতে চান। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ জাতীয় ঘটনায় সিভিল এ্যাভিয়েশন ও বিমানের ভূমিকায় মন্ত্রী বেশ অসন্তুষ্ট। এবার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ত্যাগ করার পর থেকেই বুদাপেস্টে পৌঁছার আগ পর্যন্ত তিনি যথেষ্ট সতর্ক ও তৎপর ছিলেন। ঢাকা টু বুদাপেস্টের যাত্রাপথের সার্বিক খবরাখবর রাখার পরও তার দুর্ভাগ্য- রাঙ্গাপ্রভাত যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে। এ ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই রাশেদ খান মেনন বিমানের চেয়ারম্যান ও এমডিকে পরবর্তী করণীয় হিসেবে দিকনির্দেশনা দেন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তাৎক্ষণিক লন্ডনগামী ফ্লাইটকে ডাইভার্ট করে তুর্কেমিনিস্তানে পাঠানোর নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট বুদাপেস্টে না পৌঁছা পর্যন্ত রাত বারোটায় তাকে সজাগ থেকে পরিস্থিতি মনিটর করতে দেখা গেছে। পরদিন তিনি ছুটে গেছেন অর্থমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বিশেষ উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব করে তাতে ইতিবাচক সমর্থন আদায় করেন। এ সম্পর্কে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এখন কথা বলার সময় নয়। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর কাল (বুধবার) দেখতে পাবেন দায়ী ব্যক্তিরা শাস্তি পায়, না ছাড়া পায়।
×