ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাঙ্গল মিলনমেলা

চৌরাসিয়ার উতলা বাঁশির সুরে উৎসব শেষ

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

চৌরাসিয়ার উতলা বাঁশির সুরে উৎসব শেষ

মনোয়ার হোসেন ॥ সুরের অনুরণনের শুরুটা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। সঙ্গীতের অমিত সুধা ছড়ানো আয়োজনটি শেষ হলো সোমবার। প্রতিদিনের ১১ ঘণ্টার পরিবেশনা সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাত গড়িয়ে ভোরের সূচনালগ্ন পর্যন্ত বয়ে গেছে সুরেলা স্বরধ্বনি। উপমহাদেশের খ্যাতিমান ওস্তাদ, প-িত, বিদুষীদের পাশাপাশি দেশের উদীয়মান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীরা বৈচিত্র্যময় নানা পরিবেশনায় উজাড় করে উপস্থাপন করেছেন আপন শৈলী ও কারুকার্য। মোহাবিষ্ট কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে ঝংকার তুলেছে সেতার, সরোদ, সন্তুর, তবলা, ম্যান্ডোলিন ও মধুময় বাঁশির সুর কিংবা উচ্চাঙ্গের অপরূপ নৃত্যশৈলী। পাঁচ রাতের বৈভবময় সুরভ্রমণে সিক্ত হয়েছে বিনিদ্র রজনী পার করা অগণন শ্রোতা-দর্শক। সঙ্গীতের এই সুন্দরতম দৃশ্যকাব্য সঞ্চারী ৫৫ ঘণ্টার সুর সফরের ইতি টেনে শেষ হলো পঞ্চম রজনীর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। সমাপনী রাতে সন্তুর ও বাঁশির সুরে মোহময়তা ছড়িয়েছেন প-িত শিবকুমার শর্মা ও প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তাঁদের অনবদ্য পরিবেশনায় উৎসবের পঞ্চম রজনীটি হয়ে ওঠে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। রাতজাগা উৎসুক শ্রোতাদের অপার আনন্দে ভাসিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই দুই দিকপাল সমাপনী রাতটিকে নিজের করে নেন। রাত পৌনে ১০টায় মঞ্চে আসেন শেষ রজনীর শ্রোতাদের আকাক্সিক্ষত শিল্পী প-িত শিবকুমার শর্মা। লাল পাঞ্জাবি পরিহিত কাশফুলের মতো শুভ্র চুলের এই সন্তুরবাদক প্রথমেই কথার আশ্রয়ে শ্রোতার সঙ্গে ঘটিয়ে নেন আপন সংযোগ। বলেন, এই উৎসব এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আসরে। আর উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বুঝতে হলে বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। মনোসংযোগ দিয়ে অনুভব করলেই সহজাতভাবেই এটা ছুঁয়ে যাবে শ্রোতার আত্মা। সংক্ষিপ্ত কথন শেষে সযতেœ দুই হাঁটুর মাঝে তুলে নেন বাদ্যযন্ত্রটি। ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো চোখটি বুজে পরম মমতায় শুরু করেন বাদন। বেজে ওঠে মধুর সুর। সান্ধ্যকালীন রাগ যোগের আশ্রয়ে ঘণ্টাব্যাপী পরিবেশনায় রাঙিয়ে দেন শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়। আলাপ দিয়ে শুরু করে রূপক তাল পেরিয়ে পৌঁছে যান তিন তালের সমন্বিত কম্পোজিশনে। আর এমন অনবদ্য পরিবেশনায় শ্রোতার ভালোলাগার সুবাদে ঝরে পড়ে কয়েক দফা করতালি। এর মাঝে কখনও তবলিয়ার সঙ্গে মেতে ওঠেন সুরের খেলায়, কখনও সুরকে উচ্চতায় চড়িয়ে আবার কখনও খাদে নামিয়ে সৃষ্টি বারবার ছুঁয়ে যান শ্রোতার হৃদয়। আলোড়িত শ্রোতাকে আরেক দফা মোহাবিষ্ট করে পাহাড়ী ধুনের আশ্রয়ে শেষ করেন পরিবেশনা। এই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত যোগেন শামসি। দেশের উদীয়মান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের কণ্ঠসঙ্গীত ও সেতারের সুর মূর্ছনায় এগিয়ে যায় সমাপনী দিনের আয়োজন। এরপর সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শোনা গেছে সন্তুরের ¯িœগ্ধ সুর, খেয়ালের মায়াবি আওয়াজ, সেতারের সুরেলা শব্দধ্বনি ও মন উচাটন করা বাঁশির বাদন। রাগ ভূপালীর আশ্রয়ে দলীয় কন্ঠসঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় সমাপনী রাতের পরিবেশনা। এই সম্মেলক কণ্ঠসঙ্গীত উপস্থাপন করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগের শিল্পীরা। তবলায় ছিলেন বাংলাদেশের তবলিয়া মোঃ জাকির হোসেন ও স্বরূপ হোসেন। মোঃ জাকির হোসেন শিক্ষা লাভ করেছেন ওস্তাদ আকরাম খান, ওস্তাদ হাসমত আলী খান ও দিল্লীর বীরেন্দ্র মল্ভিয়ার কাছে। অন্যদিকে ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনের দৌহিত্র স্বরূপ হোসেন বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত তবলাশিল্পী। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন বৃত্তি লাভ করে প-িত সুধীর কুমার সাক্সেনার কাছে তালিম নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্য। দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। নিশিত দে, সাম্মো দে, আশিশ নারায়ণ সরকার, প্রসেনজিৎ ম-ল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টিএম সেলিম রেজা, খন্দকার নজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যাতি ব্যানর্জী, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ, মোঃ কাওছার প্রমুখের বাদনশৈলী মাতিয়ে রাখে দর্শক-শ্রোতাদের। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে দেশের শিল্পীদের পারঙ্গমতার পরিচয় মেলে ধরে তাদের পরিবেশনা। দেশের শিল্পীদের জোড়া পরিবেশনার পর ছিল উৎসবের সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপার্সন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ও স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। এছাড়াও সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন উৎসবের আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। বক্তব্যের শুরুতে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে স্মরণ করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বলেন, আমাদের রক্তে শুদ্ধ সঙ্গীতের ধারা বইছে। এই ভূখ- থেকে একসময় ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, প-িত রবি শংকরের মতো শিল্পীর জন্ম হয়েছে। এই উৎসব চলমান থাকলে পুনরায় আমরা বিশ্বমানের শিল্পী পাব। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের চর্চা যখন স্তিমিত হয়ে পড়ছিল তখন এই উৎসব সেই চর্চাকে আবার উজ্জীবিত করেছে। যা আমাদের জাতীয় চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আনিসুল হক বলেন, শিল্পীরা পারেন একটি দেশের মননে পরিবর্তন আনতে। তাই তাদের যথাযোগ্য সম্মান যেন আমরা দেই।’ সাঈদ খোকন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পুরান ঢাকার ১২টি সঙ্গীত বিদ্যালয় পরিচালনার ভার নিতে তাকে অনুরোধ করেন এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দেন। আবুল খায়ের সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন যেন দেশে কমপক্ষে তিন হাজার সিনেমা হল তৈরি করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে একটা বড় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাই আমরা। যেখানে শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকা- হবে। বক্তব্যের শেষে তিনি আসছে জানুয়ারি মাসে তিন রাত ধরে সুফী গানের উৎসব আয়োজনের ঘোষণা দেন। সমপানী আনুষ্ঠানিকতার পর শিবকুমা শর্মার সন্তুরের বাদন শেষে খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন কুমার মারদুর। কুমার মাদুর ধারাওয়াড় গায়নরীতির একজন কুশলী কণ্ঠশিল্পী। কুমারের হাতেখড়ি তার পিতা কিরানা ও গোয়ালিয়র ঘরানার বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী প-িত সোমনাথ মাদুরের কাছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সেতার পরিবেশন করেন প-িত কুশল দাস। তিনি ভারতের একজন বিশিষ্ট সেতার ও সুরবাহার শিল্পী। রাগ দারিতে গভীর প্রজ্ঞার জন্য চ-ীগড়ের প্রাচীনকলা কেন্দ্র থেকে সঙ্গীতবিশারদ স্বর্ণপদক এবং মুম্বাইয়ের সুরসঙ্গীত সংসদ থেকে সুরমণি খেতাব অর্জন করেছেন। সেতারের তারে তারে তিনি সুরের ধারা বইয়ে দেন। এবারের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের বিশেষ দিক হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই খেয়াল পরিবেশনা ছিল। সমাপনী দিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প-িত কুশল দাসের পর খেয়াল পরিবেশেন করেন আরতি অঙ্কালিকার। বিশিষ্ট এই কন্ঠশিল্পী আগ্রা গোয়ালিয়র ঘরানার প-িত বসন্ত রাওকুলকার্নি এবং জয়পুর আত্রৌলি ঘরানার কিশোরী আমানকারের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। সুকণ্ঠী এই গায়িকার তাল ও সুরের চমৎকার খেলা এক মোহময় আবহের সৃষ্টি করে। তবলায় তাকে সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার উতলা বাঁশির সুরে সুরে শেষ হয় এই উৎসব। এই বাঁশরিয়া যখন মঞ্চে আসেন তখন গভীর রাতটি ধাবিত হচ্ছে ভোরের পানে। বেজে ওঠে ৭৮ বছর বয়সী কিংবদন্তি শিল্পীর কাঁপা কাঁপা হাতে বাঁশির সুর। প্রবাদপ্রতীম বাঁশরিয়া তোলেন মধুর থেকে মধুরতম শব্দধ্বনি। সুরেলা শব্দের অনুরণনে আপ্লুত হয় শ্রোতার অন্তরাত্মা। রাতজাগা নির্ঘুম সুররসিকদের অন্তরে ছড়িয়ে দেন অপার প্রশান্তির ছোঁয়া। আর এমন মোহনীয় পরিবেশনায় মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা কয়েক দফা করতালির সঙ্গে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান এই কিংবদন্তি বংশীবাদককে। পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত বেনারসের প-িত রাজারামের কাছে কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম নেন চৌরাসিয়া। পরে প-িত ভোলানাথের বাঁশি শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বাঁশি বাদন শিখবেন। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ। ভারত সরকার তাকে পদ্মবিভূষণ, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার ও ন্যাশনাল এমিনেন্স এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে। ডাচ রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব ওরাঞ্জন্যাসো’ খেতাব এবং ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকে নাইট উপাধি লাভ করেছেন। এবারের উৎসবে অংশ নিয়েছেন দেশের ১৬৫ জন শিল্পী ও সঙ্গতকারী। ভারতের শিল্পী ও সঙ্গতকারীর সংখ্যা ছিল ৮২। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গকৃত পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। স্কয়ার নিবেদিত উৎসবে সহযোগিতায় ছিল ব্র্যাক ব্যাংক।
×