ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে আরও দেড় হাজার গ্রামে ॥ প্রতিটি গ্রামেই হচ্ছে সরকারী প্রাইমারী স্কুল

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৪ নভেম্বর ২০১৬

শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে আরও দেড় হাজার গ্রামে ॥ প্রতিটি গ্রামেই হচ্ছে সরকারী প্রাইমারী স্কুল

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গনের আওতায় আসছে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়বিহীন আরও দেড় হাজার গ্রাম। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এসব গ্রামের জন্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দেড় হাজার সম্পূর্ণ নতুন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। যার মধ্যে এক হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠানের কাজ ১০০ ভাগই শেষ হয়ে গেছে। বাকি প্রতিষ্ঠানের কাজও এগিয়েছে ৯০ ভাগ। ৮৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া এসব বিদ্যালয়ের জন্য সৃষ্টি করা হচ্ছে সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষকের পদ। সরকার চাচ্ছে এমন গ্রাম বা এলাকায় নতুন এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে যাতে আশপাশের গ্রাম বা এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। শিক্ষাবিদরা সরকারের এ উদ্যোগে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, নতুন করে প্রতিষ্ঠিত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটি হতে যাচ্ছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। যা দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বঞ্চিত লাখ লাখ শিশুকে নিয়ে আসবে শিক্ষাদানের আওতায়। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়বে আরও দেড় হাজার গ্রামে। যেখানের শিশুরা অধিকাংশই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাবে এতদিন ছিল শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে দেড় হাজার সরকারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে বলছিলেন, আমাদের শিক্ষা বিস্তারে এটি হবে বড় একটি কাজ। আমরা চাই দেশে এমন কোন অঞ্চল থাকবে না যেখানে বিদ্যালয় থাকবে না। প্রতি এলাকায় বিদ্যালয় হবে যাতে শিশুরা শিক্ষা বঞ্চিত না হয়। মন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বেশিরভাগ কাজ হয়ে গেছে। বাকি কাজও এগিয়ে চলছে। বিদ্যালয়ের জন্য এলাকাগুলোতে মানুষ জমিদান করছে। জমিদান করলে সেখানে যেমন হচ্ছে তেমনি সেভাবে জমি না পাওয়া গেলেও সরকার জমি কিনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই দেশের প্রতিটি এলাকার শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাক। কেউ শিক্ষা বঞ্চিত থাকবে না। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমরা সর্বশেষ ২৬ হাজারেরও বেশি বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারী করেছি। এখন আর বেসরকারী নয়। নতুন প্রতিষ্ঠান হবে সরকারী। দেশের অনেক এলাকা আছে যেখান থেকে শিশুরা একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতেই পারে না। বিদ্যালয় থেকে শিশুটির বাড়ির দূরত্ব অনেক। সকল শিশুর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য এক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারের এ কাজের দেখভাল করায় যুক্ত আছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম খান। তিনি জনকণ্ঠকে কাজের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে বলছিলেন, এক হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ কাজের ৯০ ভাগেরও বেশি শেষ হয়ে গেছে। বাকি যে কাজ আছে তাও ভালভাবে শেষ হবে বলে আমরা আশাবাদী। এক প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, এটা হবে দেশের শিক্ষা বিস্তারে অনেক বড় একটা কাজ। যার প্রভাব পড়বে দেশের তৃণমূলে। অনেক গ্রাম আছে যেখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় বহুদূর যেতে হয় শিশুদের। দূর দূরান্তে যেতে হয় বলে পড়ালেখা করা সম্ভব হয় না। নতুন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো ইতোমধ্যেই কার্যক্রমও শুরু করেছে। বাকি কাজও প্রায় শেষ। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে প্রথমবারের মতো দেশে এক সঙ্গেই ৩৬ হাজার ৮৪৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এরপর থেকে এই স্তর আর আগায়নি। তবে এরশাদ সরকারের আমলে কিছু প্রতিষ্ঠান এবং বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারী হয় মাত্র ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই অবস্থায় গত মহাজোট সরকারের আমলে সরকারীকরণ হয় আরও ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। নতুন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবারের কাজ হচ্ছে প্রায় তিন দশক পর। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের বিস্তৃতি সম্পর্কে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ সৃষ্টি করা হয় এবং ২০০৩ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগকে ঘোষণা করা হয় একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। ১৯৯১ সালে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (সব ধরনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ৫৩৯টি। এ সংখ্যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ২১৮টিতে (মাদ্রাসাসহ)। এ সময়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা থেকে বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ও হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের প্রায় ২ হাজার ১০০ গ্রামে এখনও নেই কোন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিভিন্ন মহল থেকে দীর্ঘদিন যাবত এসব এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানানো হলেও সরকারীভাবে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে গত মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১ হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মূলত দুটি মানদ-কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একটি হলো- যে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হবে সে গ্রামে কমপক্ষে দুই হাজারের বেশি জনসংখ্যা থাকতে হবে। অপরটি হলো- যে গ্রামের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সে গ্রামকে প্রাধান্য দেয়া। এছাড়াও স্কুলের স্থান নির্বাচনে বন্যায় নদী ভাঙ্গন ও শিশুদের যাতায়াত সুবিধা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। বন্যার সময় যাতে স্কুল পানিতে তলিয়ে না যায় সে স্থানেই স্কুল নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন বিদ্যালয়গুলো এ টাইপ এক হাজার ১৬৯টি, ডি টাইপ ৭৯টি, অন্যান্য ৪৮টি। পাশাপাশি পাহাড়ি জনপদের ৭টি বিদ্যালয় স্থানীয় চাহিদা মোতাবেক নির্মিত হচ্ছে। প্রতিটি স্কুল ভবনে ৩টি শ্রেণীকক্ষ, একটি শিক্ষক মিলনায়তন ও দুটি টয়লেট সংযোজন করা রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের জন্য ১৬ জোড়া বেঞ্চ ও এক জোড়া চেয়ার-টেবিলসহ শিক্ষকদের রুমে ব্যবহারের জন্য আরও ৩টি টেবিল ও ৬টি চেয়ার প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা হয়। যে এলাকায় বিদ্যুত নেই সেই এলাকার বিদ্যালয়ে সোলার প্যানেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় হাওড়-বাঁওড় ও চর এলাকার ৯০টি বিদ্যালয়ের নির্মাণ হচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের চা বাগান ও আদিবাসীদের বসবাস আছে এমন এলাকাগুলোতে আনুপাতিক হারে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রাথমিক ও শিক্ষা অধিদফতর ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে একাধিকবার বলা হয়েছে, দেশের যেসব গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসব এলাকার দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার এসব গ্রামে দু-একটি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেন থাকলেও সেগুলোতে পাঠদান অনেক ব্যয়বহুল। এসব কথা মাথায় রেখেই সরকার দেশের সব শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে জোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে দেশের বিদ্যালয়বিহীন বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া, পশ্চাৎপদ, চর-হাওড়-বাঁওড়, পাহাড়ী এলাকায় একটি করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ‘বিদ্যালয়বিহীন এক হাজার ৫০০টি গ্রামে সরকারী বিদ্যালয় নির্মাণ’ প্রকল্পের সঙ্গে যারা কাজ করছেন তারা বলছিলেন, এটি প্রাথমিক শিক্ষায় অত্যন্ত ভাল ভূমিকা রাখবে। কাজের অবস্থা কি? এ প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেছেন, এক হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠানের কাজ ১০০ ভাগই হয়ে গেছে। বাকি প্রতিষ্ঠানের কাজও এগিয়েছে ৯০ ভাগ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ অনুযায়ী দেশের ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে সরকারী বা বেসরকারী কোন ধরনেরই প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। ২০০৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই পরিসংখ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে গ্রামের আয়তন ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনা করলে এক হাজার ৯৪৩টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা উচিত ছিল বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরাও। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদাকে চৌধুরীর উদ্যোগে বিদ্যালয় না থাকা গ্রামের পরিসংখ্যান বের করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুমিল্লা জেলায় এক হাজার ১৭৩টি গ্রামে, মানিকগঞ্জে ৫৪৮, টাঙ্গাইলে ৫২৮, দিনাজপুরে ৩৩৬, রংপুরে ২৩৭, জয়পুরহাটে ৩২৬, সিরাজগঞ্জে ৩৫৬, পাবনায় ৩৬৮, সাতক্ষীরায় ৩৩৫ ও নেত্রকোনা জেলায় ৮৭৯টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অন্য জেলাগুলোতেও কমবেশি একই চিত্র। টেকনাফের ছয়টি ইউনিয়নে গ্রাম রয়েছে ১৪৩টি। এগুলোর মধ্যে ৭৭টি গ্রামে সরকারী-বেসরকারী কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। ব্যক্তি উদ্যোগে দুর্গম গ্রামে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হলেও নানা সমস্যায় সেগুলোও বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রায় ৪৫ হাজারের মতো শিশু-কিশোর শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব শিশু-কিশোর লেখাপড়ার পরিবর্তে সমুদ্র উপকূলে চিংড়ি পোনা আহরণ, মাছ ধরা, পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর ও বোহাইল ইউনিয়নের মধ্যবর্তী মাত্র আড়াই কিলোমিটার এলাকায় ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অথচ বোহাইল ইউনিয়নের নদীবেষ্টিত চরমাঝিড়া গ্রামে কোন বিদ্যালয় নেই।
×