ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম. আমীর উল ইসলাম

বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৮ নভেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি

(গতকালের পর) বর্তমান নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটার লিস্ট প্রণয়ন ও জাতীয় আইডি কার্ড বা স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে একদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, অপরদিকে স্মার্ট কার্ড আমাদের আর্থ-সামাজিক নাগরিকদের জন্য পরিচয়পত্র হিসেবে ভোটার রফবহঃরঃু ও সকল প্রকার তথ্যসমৃদ্ধ নাগরিক সুবিধার এক নতুন দিগন্ত রচনা করেছে এবং নির্বাচনে তাদের ভূমিকা স্বচ্ছ থাকায় নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতার উপরে বিশ্বাস পুনঃস্থাপিত হয়েছে এবং ইহাকে আরও কি কি ভাবে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করা যায় এ নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। আর একটি প্রশ্ন অনেকেই উত্থাপন করেন এবং সঙ্গতভাবেই তারা জানতে চান, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদদের ভূমিকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৭০-এ এরূপ লেখা আছে : ৭০ (১) কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে। ব্যাখ্যা। যদি কোন সংসদ সদস্য, যে দল তাঁহাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছে, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া- (ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা (খ) সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। ৭০ (২) যদি কোন সময় কোন রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উঠে তাহা হইলে সংসদে সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতৃত্বের দাবিদার কোন সদস্য কর্তৃক লিখিতভাবে অবহিত হইবার সাতদিনের মধ্যে স্পীকার সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি অনুযায়ী উক্ত দলের সকল সংসদ সদস্যের সভা আহ্বান করিয়া বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা উক্ত দলের সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করিবেন এবং সংসদে ভোটদানের ব্যাপারে অনুরূপ নির্ধারিত নেতৃত্বের নির্দেশ যদি কোন সদস্য অমান্য করেন তাহা হইলে তিন (১) দফার অধীন উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে। ৭ (৩) যদি কোন ব্যক্তি নির্দলীয় প্রার্থীরূপে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার পর কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন, তাহা হইলে তিনি এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে উক্ত দলের মনোনীত প্রার্থীরূপে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে। অনুচ্ছেদ ৭০ (১) এর ব্যাখ্যায় একটি সংযোজন প্রয়োজন; দলের নির্দেশ অমান্য করে বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রচলিত ব্যাখ্যা হলো এরকম নির্দেশের জন্য সংসদীয় দলের বৈঠকে সাংসদগণ তাদের মতামত এবং পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিতর্ক তুলে ধরার সুযোগ পাবেন। এমন সুযোগের পর যদি সংসদীয় দল নির্দেশ জারি করে তবেই এ নির্দেশকে দলের নির্দেশ বলে মেনে নিতে হবে। অতএব এই পন্থায় বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব। হুইপ কর্তৃক নির্দেশ দেবার পূর্বে সংসদীয় দলের মুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত হতে হবে। তবে সে সিদ্ধান্ত অমান্য করলে সাংসদ পদ চলে যেতে পারে। অতএব এমন অধিকার থাকতে হবে যাতে একজন সাংসদ তার নিজের দলের সাংসদদের যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তাকে পক্ষে আনতে পারেন। এরপরও সিদ্ধান্ত তার বিপক্ষে গেলে তা মেনে নিতে হবে। ইংল্যান্ডে যেমন ঈড়হংপরবহপব ভোটের প্রথা প্রচলিত। সেগুলো সংসদীয় দলের সভায় কোন সদস্যকে তার বিবেকের কারণে ভোটদানে বিরত থাকার অধিকার দিতে পারে। মানবাধিকার মানবসত্তার মর্যাদা রক্ষিত হয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। সেই কাঠামো যখন ভেঙ্গে ফেলা হয় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা পথ হারায়। সেইসঙ্গে মানবাধিকার হয় বিপন্ন। জনগণকে আবার আন্দোলন-সংগ্রাম করে সেই মানবাধিকার গণতন্ত্র, সাংবিধানিক ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়। বাংলাদেশের জনগণ বারবার এমনি করে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করে তার অধিকার অর্জন করেছে। সেই অধিকার জনগণ তুলে দেয় নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে, তা যখন জনগণ গচ্ছিত রাখে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিপরিষদ ও নির্বাচিত সংসদে বা বিশ্বাস স্থাপন করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে যেমন বিচারালয়ে, নির্বাচন কমিশনে, জাতীয় কর্মকমিশনে, মহাহিসাব নিরীক্ষকের নিয়ন্ত্রণে, অথবা রাজনৈতিকভাবে নির্ভর করে নেতা-নেত্রী ও তাদের দলীয় প্রতিশ্রুতিতে, তখন জনগণের ন্যূনতম প্রত্যাশা যে, আল্লাহর নামে-সৃষ্টিকর্তার নামে জনগণের এই আমানত যারা গ্রহণ করেন তারা সেই ক্ষমতার প্রয়োগ শুধু জনগণের পক্ষে এবং তা কেবল জনগণের স্বার্থে এবং সংবিধানের কর্তৃত্বে কার্যকর করবেন। জনগণকে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে স¤পৃক্ত ও ওয়াকিফহাল রাখবেন। স্বচ্ছ জবাবদিহির মাধ্যমে তারা এ গচ্ছিত আমানতের ব্যবহার করবেন। অথচ যারা পবিত্র সংবিধানের নামে এই শপথ নেন তাদের স্খলন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষণের পরিবর্তে এক নির্মম হতাশায় যাতে পরিণত না হয় তার জন্য নীতিনির্ধারণে, কর্মপরিচালনায়, অভিযোগ শ্রবণে জনগণকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের পরিপূর্ণ সুযোগ দেয়ার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ তার সৃষ্টির উষালগ্নে আত্মনিয়ন্ত্রণ, মানবিক মর্যাদা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের সংগ্রামের মহান ব্রত, আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। কারণ বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগ্রামেরই ফসল। বাংলাদেশের আদর্শ, উদ্দেশ্য, স্থিতি, সমৃদ্ধি ও প্রগতি এদেশের জনগণের মানবাধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে কার্যকর করা সম্ভব। এদেশের গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করার জন্য সংবিধানের আলোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে একদিকে যেমন শক্তিশালী করা প্রয়োজন, অন্যদিকে জনগণের জাগ্রত ও সজাগ দৃষ্টি এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়ন সাধন ও অধিকার বাস্তবায়ন করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সঠিক তথ্য জানবার অধিকার এবং তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে মতামত গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি জনগণের এই অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত। সন্ত্রাস, ভয়, মিথ্যা প্রচার ও ইতিহাস বিকৃতি সত্যাশ্রয়ী ও মুক্ত সকল প্রকার বৈষম্যমুক্ত সমাজ, দুর্নীতি এবং দলীয় বা ব্যক্তির প্রভাবমুক্ত আইনানুগ দক্ষ প্রশাসন, আইনের নিজস্ব গতি সৃষ্টি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শক্তি বৃদ্ধি এবং একটি স্বাধীন মেধা ও মেরুদ-স¤পন্ন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের মৌলিক মানবাধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব। এই সকল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সঠিক রূপায়ণ করার জন্য সকল স্তরের জনগণ- পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সংঘবদ্ধ সামাজিক ঐকতান সৃষ্টিতে তাদের সক্রিয় ও সচেতন ভূমিকা অপরিহার্য। চলবে...
×