বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর একাদশ বছর পূর্ণ করে যুগপূর্তির পথে এগিয়ে গেল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫৮ বছর আগে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ২০ অক্টোবর সকাল পৌনে ১০টায় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার চত্বরে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা তুলে, বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন। পরে একটি শোভাযাত্রা ক্যাম্পাস থেকে পুরান ঢাকার রায় সাহেববাজার মোড় হয়ে আবার ক্যাম্পাসে গিয়ে শেষ হয়। বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে শুরু হয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। এই দিনটি ঘিরে পুরান ঢাকায় ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। সকলের মুখে ধ্বনিত হয় শুভ শুভ শুভ দিন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন। রাত পোহালেই কাক্সিক্ষত এ দিনটির অপেক্ষায় রাত জেগে থাকতে দেখা যায় শত শত জবিয়ানদের। কয়েক দিন আগে থেকেই ক্যাম্পাস এলাকায় রং-বেরঙের ঝলমলে বাতির আলোয় সৃষ্টি হয় এক নান্দনিক পরিবেশ। বিভিন্ন রঙের বেলুন, ফেস্টুন আর বৈদ্যুতিক বাতিতে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। নতুন সাজে সজ্জিত হয় পুরো ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের নতুন রূপ বারবার শুনিয়ে যায় দিনটির আগমনী বার্তা। শিক্ষার্থীদের মাঝে তাই এ দিনটিকে ঘিরে এক অন্যরকম ভাললাগা কাজ করতে থাকে। গতবারের তুলনায় এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের আনন্দ উল্লাসের মাত্রা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যখন যোগ হয় নগর বাউল, জেমসÑ তখন তো সোনায় সোহাগা। খুশির ভেলায় ভাসতে থাকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, সঙ্গে শিক্ষক-কর্মচারী এবং পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। চারিদিকে বাদ্যবাজনা আর খুশির আমেজ থাকে বহমান। হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রাক্তন জবিয়ান আর স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে শুরু হয় এক অন্যরকম মিলনমেলা।
আজকের এইদিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবর্তিত হয় বলে এ দিনটিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল একটি পাঠশালা মাত্র। মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এর ৩২টি বিভাগে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমস্থান অধিকার করেছে। এবারের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ৩৬তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) চূড়ান্ত পরীক্ষায় এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩৯২ শিক্ষার্থীর বিভিন্ন সেকশনে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন। এতে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় শিক্ষার্থীদের গড় হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমস্থান অধিকার করেছে। এমন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা দিবস তো একটু জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হবেই। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রার পর হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ ১২ বছরে এসে দাঁড়িয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এ বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় ছিল ব্রাহ্মদের স্কুল। শিক্ষার আলোয় অলোকিত করতে ১৮৫৮ সালে শুরু হয় যার পদযাত্রা। ১৮৭২ সালে এর নাম বদলে রাখা হয় জগন্নাথ স্কুল। পরে তা কলেজে উন্নীত হয়। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পরিবর্তিত হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে জগন্নাথ কলেজের ¯œাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এ কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বই-পুস্তক জার্নাল এমনকি বেঞ্চ চেয়ার টেবিলও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। যার স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ে জগন্নাথ হল নামে একটি হলও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এরপর একটি বিষয় গর্বের সঙ্গে আজও স্মরণ করে জগন্নাথ। সেটি হলো ১৯৯২ সালে ভাষা আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শহীদ রফিক উদ্দীনের (ভাষা শহীদ রফিক) আত্মত্যাগ। এছাড়া শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফা দাবির আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথান, আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো সমস্ত আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়, যা কখনই ভুলার নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হলে এ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকায় হরতাল দিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে এ প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীরসহ নাম না জানা অনেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর ক্যাম্পাসে কয়েকটি গণকবর পাওয়া গেলে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে সবচেয়ে বড় গণকবরটির ওপর ’৭১-এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নামে বাংলাদেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সর্বশেষ এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তবে একটি বিষয় অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর জন্যও একটি আবাসন ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের এ ন্যায্য দাবির পক্ষে দফায় দফায় আন্দোলনের পর ছাত্রীদের জন্য বেগম ফজিলাতুন্নেছা নামে একটি ছাত্রী হল নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে হলটির এক তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়ে দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছে।
এছাড়া কেরানীগঞ্জের বাঘৈর গ্রামে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বিপরীত পাশে ছাত্রদের জন্য দুটি হল এবং বিজ্ঞান ভবনের জায়গায় একটি ২০তলা বিশিষ্ট একাডেমিক ভবনের নির্মাণ বাজেট একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এত সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও এবারের অনার্স ২০১৬-১৭ প্রথম শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করে।