(পূর্ব প্রকাশের পর)
নির্দেশক : সে আমলের কথা ভুলে যাও। সে সিস্টেম এখন আর নেই।
ছেলে : তাহলে... ইমপো?
নির্দেশক : আপাতত। সেটাও আমার নির্দেশ মতো।
ছেলে : বেশ। কিন্তু এখন?
নির্দেশক : (যেন হঠাৎ ওয়েটারকে দেখে) ওয়েটার ভেতরে চলে যায়। ছেলেটি বিষণ্ণ মনে বসে পড়ে। (ছেলে সিগারেট ধরায়) ছেলেটি সিগারেট ধরায়।... ডায়ালগ।
(ছেলেটি নিশ্চুপ। উদাস মনে সিগারেট টানতে থাকে।) নীরব কেন? শুরু করো।
ছেলে : ভাব- ভাবের জন্যে। ভাবতে হবে। (সিগারেট টানে)
নির্দেশক : ছেলেটি ভাবের ঘোরে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়ে।
ছেলে : না, না, গান নয়। গান কেন? কেন বিরহের গান গাইবো! সেটা হবে আমার পরাজয়। তার চেয়ে আমি চলে যাবো। সেই হবে তার চরম শাস্তি। এসে যখন দেখবে আমি নেই। নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলবে। বিরহের গান তখন সেই গাইবে। আমি কেন? তারপর হয়তো আমাকে টেলিফোন করবে। আমাকে পাবে না। আমি তো বাড়িতে নেই তখন- পার্টিতে। কিন্তু যদি পার্টিতে যেয়েই হাজির হয়। এমনো তো হতে পারে, অন্য পার্টিতে চলে গেলো। মরুক গে, আমি চললাম।
নির্দেশক : প্রচ- বিক্ষোভে সে সিগ্রেটটা এ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে দাঁড়ায়। পকেট থেকে রুমাল বের করে। মুখ মুছে। রুমালটা পকেটে রাখে। দরজার দিকে এগোতে থাকে। ঠিক তখনি প্রবেশ করে মেয়েটি। ছেলেটি থমকে দাঁড়ায়। মেয়েটিও থমকে দাঁড়ায়।
ছেলে : এতোক্ষণে সময় হলো!
মেয়ে : আমি তো অনেকক্ষণ আগেই এসেছিলাম।
ছেলে : আমিও অনেকক্ষণ আগে এসেছি।
মেয়ে : আমি এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলাম। কেন, ওয়েটার তোমাকে বলেনি।
ছেলে : কই, না তো।... ওয়েটার
নির্দেশক : ওয়েটার দ্রুত পায়ে ছুটে আসে।
ছেলে : এর আসার কথা আমাকে তুমি আগে বলোনি কেন?
ওয়েটার : ও, আপনিই সেই লোক!
ছেলে : মানে!
ওয়েটার : মেয়েকে দেখিয়ে উনি বললেন, লম্বা চুল, ইয়া জুলফি, বর্ষার ঘাসের মতো গোঁফ, বাহারি পোশাক... আপনার তো...
মেয়ে : (এতোক্ষণে লক্ষ্য করে) তাই তো! তুমি যে একেবারে... হঠাৎ এই চেহারা, পাজামা পাঞ্জাবি...
নির্দেশক : ছেলেটি কিঞ্চিৎ দমে যায়। ফিরে যায় টেবিলে। মেয়েটি তাকে অনুসরণ করে। ছেলেটি বসে।
মেয়ে : কি হলো?
নির্দেশক : মেয়েটিও বসে। (বসার আগে চেয়ারে হাতব্যাগ ঝুলিয়ে দেয় অথবা টেবিলে রাখে।)
ছেলে : আর বলো না। এক অর্থে যদিও আমার ব্যক্তি স্বাধীনতার পরাজয়। অন্যদিকে অবশ্য আমার লাভই হয়েছে।
মেয়ে : ব্যাপারটা বলো।
ছেলে : বাবার কাছে দু’শো টাকা চাইলাম। বাবা বললেন, তোকে তিন’শো টাকা দেবো কিন্তু একটা শর্তেÑ যদি তুই জুলফি গোঁফ, কামিয়ে দিস, চুল ছোট করে ফেলিস, না হলে দু’টাকাও নয়।
মেয়ে : আর তুমি মেনে নিলে! তোমার এত সুন্দর চুল, গোঁফ দেখলেই আমার মনটা যে কেমন শিরশির করে উঠতো।
ছেলে : আহ্, শোনোই না, ভেবে দেখলামÑ চুল গোঁফ তো আবার গজাবে, তিন’শো টাকা তো গজাবে না। তাই রাজি হয়ে গেলাম।
মেয়ে : কখন হলো এটা।
ছেলে : দুপুরে।
মেয়ে : তুমি সত্যিই খুব স্মার্ট।
ছেলে : হা: হা:, আর তুমি কিনা আমাকে লাজুক বলতে।
মেয়ে : কেন বলবো না! প্রথম প্রথম তুমি যা করতে। আমাদের বাসায় যেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে। কিন্তু আমাকে তোমার পাশে বসতে বলতে না। আমিই তোমার গা ঘেঁষে বসতাম। তারপর বাইরের সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবার সময়ও তোমার পাশে যেয়ে দাঁড়াতাম। তবুও আমার হাতটাও ধরতে না।
ছেলে : আর এখন?
মেয়ে : তুমি... (বলেই থেমে যায়, একটু আমতা আমতা করে) তো এতো দেরি হলো কেন তোমার?
ছেলে : সেও আরেক ব্যাপার। তোমার না শুনলেও চলবে।
মেয়ে : কেন নয়। খুব গোপন কিছু।
ছেলে : না, তেমন কিছু নয়।
মেয়ে : তাহলে?
ছেলে : ওই...
নির্দেশক : চমৎকার হচ্ছে, চমৎকার।
মেয়ে : বলছো না কেন?
ছেলে : ওই... আমার এক বন্ধুর বোনকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম।
নির্দেশক : মেয়েটি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
মেয়ে : কি? তুমি এদিকে...
ছেলে : রাগ করছো কেন? ওই বন্ধুটিও আমার বোনকে মাঝে মাঝে পৌঁছে দিয়ে যায়।
মেয়ে : তোমার সে বন্ধুর ঠিকানা কি? ফোন নাম্বার কতো?
ছেলে : কেন?
মেয়ে : আমাকেও মাঝে মাঝে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
ছেলে : (উঠে দাঁড়ায়) এতোক্ষণ পর দেখা হলো, আর তুমি কিনা (বলতে বলতে মেয়েটির পিঠে হাত রাখে।)
নির্দেশক : (চেয়ারে বসেই, গরম ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে) একি, গায়ে হাত দিচ্ছ কেন?
ছেলে : (পিঠে হাত রেখেই) এমন আবেগময় দৃশ্য...
নির্দেশক : হোক আবেগময়। ছেড়ে দাও। ওসব আমার নাটকে চলবে না।
ছেলে : একেবারেই না।
নির্দেশক : তা... বড়জোর হাতে হাত রাখতে পারো।
ছেলে : (হাত নামিয়ে) বেশ। (মেয়েকে) এতোক্ষণ পর দেখা হলো...
নির্দেশক : মেয়েটি সবেগে ঘুরে ছেলেটির মুখোমুখি দাঁড়ায়।
মেয়ে : আমিও তাই বলতে চাইছি। এতোক্ষণ পর দেখা হলো আর তুমি কিনা এমন একটা কথা বললে...
ছেলে : আমি সত্যি কথাটাই বললাম। সত্য প্রকাশ করাই তো...
মেয়ে : থাক, আর বিদ্যাসাগর আওড়াতে হবে না।
নির্দেশক : মেয়েটি চেয়ারে বসে পড়ে।
মেয়ে : সব সময় মিথ্যে বলে অভ্যেস, আর এখন! আরেকটা মিথ্যে বললে কি ক্ষতি হতো? আমার মনটা খুশি লাগতো।
ছেলে : তুমি তাও সন্দেহ করতে।
নির্দেশক : ছেলেটাও বসে।
মেয়ে : সন্দেহ করাটাই আমাদের স্বভাব। সত্য বললেও করে থাকি।
ছেলে : ওয়েটার।
মেয়ে : ওয়েটারকে সালিশ মানবে নাকি!
(উপরের সংলাপ চলাকালে একজন খরিদ্দার নির্দেশকের আসনের পিছন দিয়ে বাইরে চলে যায়।)
নির্দেশক : ওয়েটার দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে। টেবিলে মেনু রাখে।
ছেলে : কি খাবে বলো।
মেয়ে : (মেনু দেখতে দেখতে) ফুচকা। (ওয়েটার পকেট থেকে কাগজ-কলম নিয়ে অর্ডার লিখে নেবে।)
ওয়েটার : চটপটি!
মেয়ে : হ্যাঁ, হ্যাঁ, দুটোই।
ওয়েটার : আর কিছু!
ছেলে : আমার জন্যে স্যান্ডুইচ।
নির্দেশক : মেয়েটি কুপিত চোখে তাকায়।
ছেলে : আমার খিদে পেয়েছে। (ওয়েটারকে) দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
নির্দেশক : ওয়েটার চলে যায়।
মেয়ে : খিদে না ছাই। আমি যদি স্যান্ডুইচ চাইতাম, তাহলে তুমি ফুচকা বলতে।
ছেলে : ঠিক আছে, তুমিও স্যান্ডুইচ খেয়ো।
মেয়ে : (ন্যাকামো কণ্ঠে) তার সঙ্গে কোল্ড ডিংকও।
(নীরবতা। ছেলে ও মেয়ে ইতস্তত করতে থাকে।)
কাঞ্চু : আবু, ওরা চুপ মেরে গেলো কেন রে?
নির্দেশক : ও তুই বুঝবিনে। আধুনিক নাটকে সাইলেন্স খুব ইমপর্ট্যান্ট। টমাস ডেকেটের নাম শুনেছিস?
কাঞ্চু : ওÑ
(ছেলে সিগারেট ধরায়)
নির্দেশক : (স্বাগত) ইস, আবারো সিগ্রেট ধরিয়েছে।
ছেলে : এই, এর পরে যেন কি?
মেয়ে : তাইতো।... তোমার যেন কি একটা এ্যাকশন আছে।
ছেলে : মনে পড়ছে না।
মেয়ে : তাহলে ওই গানটানের কথা শুরু করে দাও।
ছেলে : ফাইন।
নির্দেশক : কি হলো, চুপ করে আছে কেন? এ্যাকশন। ড্রামা ইজ নাথিং বাট এ্যাকশনÑ বলেছেন শেক্সপিয়ার।
ছেলে : নাথিং বাট ইমপ্রোভাইজেশন।
কাঞ্চু : নাথিং বাট সাইলেন্স।
নির্দেশক : (হঠাৎ উঠে গিয়ে ছেলের কাছে আসতে আসতে) অসম্ভব। আমার নির্দেশ এ্যাপ্রুভাল ছাড়া কোন ইমপ্রো হবে না। এটা অন্যায়।
ছেলে : হবে, হবে। আপনার নির্দেশকের পদ বজায় রাখার জন্যেই আরো ঢের অন্যায় আপনাকে মেনে নিতে হবে। আপনি খুশি হয়েই মেনে নেবেন।
(মেয়ে মুখে হাত রেখে হাসি চাপতে চেষ্টা করে। সিগ্রেট এ্যাশট্রেতে গুঁজে দেয়।) (চলবে)
শীর্ষ সংবাদ: