ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাতৃভাষায় শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মাতৃভাষায় শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের

বিভাষ বাড়ৈ ॥ স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পর অবশেষে দেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের পথ উন্মুক্ত হতে চলেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই মাতৃভাষায় পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। প্রথমবারের মতো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ওরাও এবং গারো জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ও শিক্ষা উপকরণ। পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরে অন্যান্য আদিবাসী শিশুও মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ইতোমধ্যেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষার পাঠ্যবই প্রণয়ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পথ উন্মুক্ত করতে পারায় সন্তোষ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী বছর প্রথম দিন থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। প্রথমবারের মতো তাই চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদ্রি ও গারো ভাষায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই। কাজ ভালভাবে এগোচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তবে কেবল শুধু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্যই নয়, প্রথমবারের মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল বইয়েরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ বছর বিভিন্ন স্তরের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দেয়া হবে নয় হাজার ৬৬টি বই। এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য ‘টিচার্স গাইড’ (প্রাথমিক) ও ‘টিচার্স কারিকুলাম এ্যান্ড গাইড’ (মাধ্যমিক) নামে পাঠদানে সহায়ক বই প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য ৫৮ সেটে ষাট লাখ এবং মাধ্যমিকের জন্য চল্লিশ লাখ বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য নয় হাজার ৬৬ ব্রেইল বই ছাপাচ্ছি, যা বছরের শুরুর দিনই দিতে পারব বলে আশা করি। শিক্ষামন্ত্রী জানান, ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তক উৎসবে ৩৬ কোটি ৩ লাখ বই বিতরণ করা হবে। প্রতিবছরের মতো আগামী বছরও ১ জানুয়ারিতে দেশের পাঠ্যপুস্তক উৎসবে ৩৬ কোটি ৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৭৯টি বই বিতরণ করা হবে। চলতি বছর যা ছিল ৩৩ কোটি ৪৫ লাখ। জানা গেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার থাকলেও গত দুই দশক তা ছিল স্বপ্ন। সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘেও স্বীকৃত। তারপরও এতদিন দেশের আদিবাসীদের জন্য ছিল কেবলই স্বপ্ন। তবে সে স্বপ্ন পূরণেই এবার এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এনসিটিবি জানিয়েছে, চার বছর আগে প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা (এমএলই) বিষয়ক জাতীয় কমিটিও গঠন করেছিল সরকার। পুস্তক ছাপানোর প্রস্তুতির নানা ধাপ ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন তা ছাপা হচ্ছে। বিষয়টির প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী। তিনি বলছিলেন, আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের হাতে মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বই পৌঁছে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে মোট ২৪ হাজার ৬৪৬ জন শিশুর জন্য বই ও শিক্ষা উপকরণ ছাপানো হচ্ছে। এই বিশেষজ্ঞ জানান, আমাদের পবিত্র সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘেও স্বীকৃত। তারপরও এতদিন দেশের আদিবাসীদের জন্য ছিল একটি কেবলই স্বপ্ন। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের হাতে দ্রুত মাতৃভাষায় পাঠ্যবই তুলে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তাগাদা দিয়েছেন। নজর রাখছেন সব সময়। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগের কারণেই আমরা আজ এ কাজটি করতে পারছি। অন্যথায় এ কাজ সফল করা সম্ভব হতো না বলে জানান এনসিটিবির এই সদস্য। এনসিটিবি সূত্র জানায়, বইগুলো লেখা, সম্পাদনা, চিত্রায়ণ প্রভৃতি কাজ ইতেমধ্যেই শেষ হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতির চিত্রায়ণসহ আনুষঙ্গিক বিষয় দিয়ে বইগুলো সাজানো হয়েছে। যে পাঁচটি জনগোষ্ঠীর ভাষায় বই ছাপানো হচ্ছে সেগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং ওরাও। অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী জানান, পাঁচটি ভাষায় বই হচ্ছে। চাকমাদের বই তাদের নিজস্ব বর্ণমালায় ছাপা হচ্ছে। গারোদের আচিক ভাষা হলেও তাদের বর্ণমালা নেই। তারা মূলত রোমান বর্ণমালায় তা পড়ে থাকে। তাই তাদের বই হবে রোমান বর্ণমালায়। মারমাদের বই মামরা ভাষায় হলেও তাদের যেহেতু নিজস্ব বর্ণমালা নেই তাই বই হবে বাংলা বর্ণমালায়। ত্রিপুরাদের ভাষা ককবরক। তবে তাদের বইও হবে বাংলা বর্ণমালায়। ওরাও জনগোষ্ঠীর ভাষা সাদ্রি। তাদের বইও হবে বাংলা বর্ণমালায়। এনসিটিবি সূত্র জানায়, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বইয়ের হরফ সম্পর্কে নানা মত আসায় এ বছর তাদের জন্য বই ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না। সাঁওতালদেরও প্রতিনিধিরা কেউ বাংলা এবং কেউ রোমান লিপিতে বই লেখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। পরবর্তী বছর থেকে তাদের বই নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীও পাবে নিজস্ব ভাষার বই। জানা গেছে, ২০১৮ সালে দেয়া হবে আদিবাসী শিশুদের প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যবই। এর পরের বছর ২০১৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরও মাতৃভাষায় বই দেয়া হবে। এসব বই বিনামূল্যে পাবে শিক্ষার্থীরা। এ জন্য অর্থসহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা কোন শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ পাবেÑ জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য ড. রতন সিদ্দিকী বলেন, সাধারণভাবে বলা যায়, প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত তারা এ সুযোগ পাবে। তবে দ্বিতীয় শ্রেণীর পর তৃতীয় শ্রেণী থেকে তাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজী প্রভৃতি বই পড়তে হবে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে এই দুইয়ের মধ্যে ‘ব্রিজিং’ শুরু হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে তারা পুরোপুরি জাতীয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে। শিক্ষানীতির ভাষায় এটা হচ্ছে ‘ব্রিজিং’। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, কোন শিশুকে ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়া জরুরী। এরপর সে ধীরে ধীরে মাতৃভাষার সঙ্গে অন্য ভাষায় (বাংলাদেশের জন্য বাংলা) শিক্ষা নেবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় সাত বছর। এ সময়টাকে বলে ‘ব্রিজিং পিরিয়ড’। জাতীয় শিক্ষানীতিতেও শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এদিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য বই ছাড়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্র জানায়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু করারও প্রক্রিয়া চলছে। তবে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানোর মতো শিক্ষক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক আছে। তাই আগামী জানুয়ারির আগেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক অপরিহার্য নয়। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলছিলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যারা শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন, তারা হয়ত প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদান করতে পারবেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। সব জায়গায় তো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নেই। বিভিন্ন সময় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের কোটা অনুযায়ী নিয়োগ না দেয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। তাই মাতৃভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষা শুরু করতে হলে বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরীভিত্তিতে এ জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। অন্যথায় এ পাঠ্যবই প্রণয়নের সুফল পাওয়া যাবে না। এ নিয়োগ দ্রুত হতে হবে। দেশে সরকারী হিসেবে ৩৭টি এবং বেসরকারী হিসেবে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থাকলেও অধিকাংশই নিজস্ব লিপি নেই। অনেকে তাই বাংলা ও আবার অনেকে রোমান হরফে তাদের ভাষার বই পড়তে রাজি হয়েছেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। স্বস্তি প্রকাশ করছেন তারা। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরেই বলছেন, একটি দেশে হাজারটি ভাষা থাকলে সে দেশের সংস্কৃতি আরও প্রগাঢ় হয়। পাকিস্তান আমাদের বাংলাকে এক সময় স্বীকৃতি দিতে চায়নি, সেটা তাদের বড় ভুল ছিল। আমাদের দেশের সংস্কৃতি হাজারও ভাষা ও বৈচিত্র্যে ভরে উঠুক এবং তাদের স্বীকৃতিস্বরূপ বই সরবরাহসহ নানাবিধ সরকারী সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক। সবার মিলেমিশে বসবাসের স্বর্গভূমিতে পরিণত হোক আমাদের মাতৃভূমি।
×