ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সময়ের দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সময়ের দাবি

বিভাষ বাড়ৈ ॥ একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গণদাবি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবার আদালতে ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধে দায়ী সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। সামনে চলে এসেছে যুদ্ধাপরাধী ও অভিযুক্ত দল জামায়াতের সম্পদ বাজেয়াফত করার গণদাবিও। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের উদ্যোগের কথা জানালেও প্রশ্ন উঠেছে জামায়াত নিষিদ্ধে কেন কালক্ষেপণ? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সক্রিয় প্রতিটি মানুষের দাবি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এমনকি উচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল’ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও জামায়াত নিষিদ্ধে কালক্ষেপণ চলবে না। জামায়াতের বিচার করলেই হবে না, দলটির অর্থের উৎসও বন্ধ করতে হবে। বাজেয়াফত করতে হবে সম্পদ। অন্যথায় দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করার অপতৎপরতা কোনদিন বন্ধ হবে না। রবিবার সংসদ ভবনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ও আনসার আল ইসলামসহ সব ধরনের জঙ্গী সংগঠন সরকার নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠেছে শুধু শিবির নিষিদ্ধ কেন, মূল সংগঠন জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকার কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না? একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত কবে নিষিদ্ধ হচ্ছে? রাজনৈতিক সচেতন প্রতিটি মানুষের কাছে আলোচিত এই বিষয়টির কবে সুরাহা হবে, জানে না কেউই। একের পর এক রায়, ফাঁসি সর্বশেষ জামায়াতের আর্থিক যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ ও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি আলোচনা এসেছে জোরালোভাবে। হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনালের রায় আমলে নিয়ে শুধু গেজেট প্রকাশ করেই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি দেশের সংবিধান সম্মত। এর আগে অনেক সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠনকে একইভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিরাপত্তা বিশ্লেষক, আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকার জনস্বার্থে যে কোন অপরাধী ও সংগঠনকেই নিষিদ্ধ করতে পারে। উচ্চ আদালত ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণ হয়েছে, জামায়াত অপরাধী সংগঠন। ট্রাইব্যুনালের এবং হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ভিত্তিতে সরকার চাইলে যে কোন সময় দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিও জামায়াত নিষিদ্ধ সময়ের ব্যাপার বলে উল্লেখ করছেন বহুবার। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে ‘সংগঠনের স্বাধীনতা’য় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- যদি কোন সংগঠন, (ক) নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশে গঠিত হয়, (গ) রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশে গঠিত হয় এবং (ঘ) সংগঠনের গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়- তবে সমিতি বা সংগঠন করার অধিকার তাদের থাকবে না। সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইন হওয়ার পরেও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ না হওয়া হতাশাজনক। সরকারের সদিছাই এখন যথেষ্ট। সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কোন সংগঠনকে সরকার নিষিদ্ধ করতে পারে। এছাড়া রাষ্ট্র, নাগরিক বা দেশে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কাজে পরিচালিত কোন সংগঠনকেও সরকার চাইলেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। আদালতের রায়ের পর সরকার যে কোন মুহূর্তে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। কারণ, যুদ্ধাপরাধ মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারী- বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্থান না দিতে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে যাতে তারা স্থান না পায়, তাও নিশ্চিত করতে সরকারকে বলা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে ‘পাকিস্তান রক্ষার’ নামে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ তৈরির মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগিতা করে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া প্রথম রায়েই। ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের পর থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠতে থাকে। জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চুৃ রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেছিল দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। রায়ে মামলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বিবরণ দিতে গিয়ে আদালত বলেছে, পাকিস্তান রক্ষার নামে একাত্তরে নিরস্ত্র বাঙালী জনগোষ্ঠীকে নিপীড়নের জন্য আধাসামরিক বাহিনী গঠনে ভূমিকা রাখে জামায়াতে ইসলামী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন তখনই বলেছিল, এতদিন তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ থাকলেও রায়ের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে দেয়া রায়েই প্রমাণিত জামায়াত অপরাধী সংগঠন। তখনই বিশেষজ্ঞরা মত দেন, এই অপরাধে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব এখন রাজনৈতিক দল, সরকার ও জাতীয় সংসদের। এখানেই শেষ নয়। একাত্তরের ঘাতক জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের সাজা দিয়ে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছিল, ওই রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- চেয়ে আপীল করেছিল সরকার। ওই আপীলে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের আবেদন করা হয়েছিল। আপীলটি শুনানির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় গোলাম আযম মারা যায়। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আপীলেরও পরিসমাপ্তি হয়। এ কারণে জামায়াত নিষিদ্ধ চেয়ে আপীল বিভাগে করা সরকারের আবেদনেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। আর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চেয়ে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল করিম চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তির করা রিট আবেদনের রায়ে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বেআইনী ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। ওই রায়েও জামায়াতকে একটি ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রায় দেড় বছর ধরেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বিভিন্œভাবে বলে যাচ্ছেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী? প্রায় এক বছর আগে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত রিপোর্টও দাখিল করে প্রসিকিউশন? তদন্ত কর্মকর্তাদের একজন বলছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা ? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে যে সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা রয়েছে? তারা এই অপরাধ প্রমাণের জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্ট, তথ্য ও দলটির অর্গানোগ্রামসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেছে? তিনি আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন এই দলটির যুদ্ধাপরাধ পরবর্তী দলটির নানা কার্যক্রমও তদন্ত হচ্ছে? তবে নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ। ওই তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলছিলেন, তদন্তে প্রমাণিত ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়? শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ অনেক অপরাধ হয়েছে জামায়াতের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে? দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে জামায়াত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে এবং এজন্য রাজাকার, আলবদর ও আল শামসসহ নানা বাহিনীও গঠন করে? আর এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ও মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের নেতাকর্মীরা ছিলেন? কিন্তু তার পরেও জামায়াত নিষিদ্ধ হচ্ছে না। এবার মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের পর জামায়াত নিষিদ্ধ ও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি নতুন করে জোরালো হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেও জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী সামরিক সরকারের আমলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তা উন্মুক্ত করে দেন এবং স্বাধীন দেশে রাজনীতি করার অধিকার পায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত। তবে এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সক্রিয় প্রতিটি মানুষের দাবি, সময় এসেছে, দ্রুত জামায়াতের রাজিনীতি নিষিদ্ধ করার। একই সঙ্গে মীর কাশেমসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর সম্পদ বাজেয়াফত করে, তা জনকল্যাণে ব্যয় করার। তবে গত বছর ৬ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন আর্থিক, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয়ার পর এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান অগ্রগতি কি তা জানতে না পারায় হতাশা প্রগতিশীল প্রতিটি মানুষ। এর আগেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছিল। তার পর কি হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে জনমনে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আছে অসংখ্য জামায়াত নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম। এর বাইরে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চ, সেøাগান ’৭১ প্রকাশ করে জামায়াতের প্রতিষ্ঠানের তালিকা। যেখানে আছে অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও প্রকাশনা সংস্থা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তেও উঠে আসা জামায়াতের ১২৭ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ২২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক গবেষক শাহরিয়ার কবির বলছিলেন, শুধু জামায়াতের বিচার করলেই হবে না। দলটির অর্থের উৎস বন্ধ করতে হবে। কারণ জামায়াত নানা কৌশলে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করছে এবং সেই অর্থ দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করতে ব্যয় করছে। ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়নি। এখন এ অপরাধীদের সম্পদও বাজেয়াফত করে শহীদ পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াতের বিচার দু’ভাবে অর্থাৎ একাত্তরে গণহত্যা ও বর্তমানে যেসব সন্ত্রাসী ভূমিকা দলটির রয়েছে, তার জন্য হতে পারে। এ ছাড়া দলটির অর্থের উৎস বন্ধ করতে হলে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। দলটির অর্থের উৎসও বন্ধ করতে হবে। বাজেয়াফত করতে হবে সম্পদ। অন্যথায় দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করার অপতৎপরতা কোনদিন বন্ধ হবে না। তিনি আরও বলেন, আরেকটি জরুরী বিষয় হচ্ছে, সংগঠনের বিচার করার কাজে সরকার কেন কালক্ষেপণ করছে? একাত্তরে মীর কাশেমরা যেসব ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে তো করেননি। দলের সিদ্ধান্ত ছিল, রাজনীতি ছিল। সে অনুসারেই তারা গণহত্যা চালিয়েছেন। তাদের একটা দর্শন রয়েছে, যাকে আমরা মওদুদীবাদ বলি। এই মওদুদীবাদ গণহত্যাসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধকে ইসলামের নামে বৈধতা দেয়। তারা এই যে মীর কাশেমকে শহীদ বলছে, এ তো মওদুদীবাদী রাজনীতি। হলি আর্টিজান কিংবা কল্যাণপুরের ঘটনায় আমরা দেখেছি, সন্ত্রাসীরা বলছে তারা শহীদ হচ্ছে এবং বেহেশতে যাচ্ছে। তারা ‘শহীদ’ হওয়ার জন্য এসব করছে। এ তো শাহাদাতের ভাবনা হতে পারে না। প্রকৃত ইসলামে যারা বিশ্বাস করে তারা জানে একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করলে কেয়ামতের পর শাস্তি পেতে হবে। মীর কাশেম ও তার পরিবারের উচিত ছিল জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। জাতি ক্ষমা করলে এর পরে আসছে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন। বিষয়টি সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে। এ জন্যই আমরা বলছি, মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস অস্বীকার করার দ- বিধানে শক্ত আইন করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের সদস্য ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন দিয়ে তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। দলের সম্পত্তি বাজেয়াফত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে তাদের অপরাধী সংগঠন প্রমাণ করে আদালতের কাছে দাবি করতে হবে, যেন কোন জামায়াত-শিবির সদস্য এদেশে আর রাজনৈতিক তৎপরতার নামে জঙ্গী তৎপরতায় যুক্ত হতে না পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় জার্মানির নাৎসি পার্টির নেতাদের শাস্তির পাশাপাশি দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয় নুরেমবার্গ ট্রায়ালে। এই উদাহরণ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারে বেসরকারী সংগঠন ওয়ার ক্রাইমস ফাইন্ডিং ফ্যাক্টস কমিটির চেয়ারপার্সন ডাঃ এম এ হাসান বলেন, সংবিধান অনুযায়ী, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন দলের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে আসছি। উচ্চ আদালত ও ট্রাইব্যুন্যাল যথার্থ রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, জামায়াত অপরাধী সংগঠন। এদেশে রাজনীতি করার অধিকার জামায়াতের নেই। ঐতিহাসিক এই দুই রায়ের ভিত্তিতে সরকার চিরতরে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। জামায়াত নিষিদ্ধ ও তাদের সম্পদ বাজেয়াফত করার এখনই সময় দাবি করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে গেছে। ‘যুদ্ধাপরাধী দল’ হিসেবে এখনই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার উপযুক্ত সময়। আমরা মনে করি, সে সংগঠনের রাজনীতি করার কোন অধিকার থাকতে পারে না। ওদের সম্পদ বাজেয়াফত করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, যুদ্ধাপরাধীরা যে সম্পদের পাহাড় গড়েছে, এ সম্পদ বাজেয়াফত করে শহীদ পরিবারকে দিতে হবে। না হলে শহীদ পরিবারের প্রতি আমরা ন্যায়বিচার করতে পারব না। তিনি বলেন, রায়ের মধ্যেই তাদের সম্পদ বাজেয়াফতের কথা থাকা উচিত। কর্নেল তাহের ও আমাদের অন্য দুই ভাইকে গোপন বিচারেও সাজার সঙ্গে অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াফতের নির্দেশ ছিল। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের রায়ে এসব নেই। শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছি। মানবতাবিরোধীদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের যাবতীয় সহায়-সম্পত্তিও বাজেয়াফত করতে হবে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের হাতে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন অনেক ক্ষতিগ্রস্তকেই চিনি, যারা এখনও ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীর সম্পদ মৌলবাদের অর্থনীতিকে আবারও সমৃদ্ধ করবে। যদিও গেল সপ্তাহে সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদও বাজেয়াফতের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি যুদ্ধাপরাধীদের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ বাজেয়াফত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত যেন বাংলাদেশে ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে না পারে, সে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে জামায়াত-শিবিরের সকল বই বাজেয়াফত করে পুড়িয়ে ফেলার দাবি জানিয়েছে সম্মিলিত ইসলামী গবেষণা পরিষদ। সম্প্রতি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে ‘ইসলাম বিকৃতি ও ফেৎনা সৃষ্টিকারী, মওদুদী, ইজমবাদী, মানবতাবিরোধী এবং ’৭১’র নরঘাতকদের সকল বই বাজেয়াফত করার দাবিসহ জঙ্গীবাদ নির্মূলের দাবিতে সংগঠনটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। সমাবেশে ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামারা জামায়াত-শিবিরকে ইসলামের শত্রু অভিহিত করে বলেছেন, জামায়াত-শিবির ইসলামের নামে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। প্রকৃতপক্ষে এরা ইসলামের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শত্রু। তাই অনতিবিলম্বে তাদের প্রকাশিত সব বই বাজেয়াফত করতে হবে। নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা মুসলমান। পবিত্র ইসলাম আমদের ধর্ম। কোরান- হাদিসে বিশ^াসী ও সঠিক গবেষণাকারী, সাহাবায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়েজামদের অনুসারী আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকিদায় বিশ্বাসী ও অবিচল। আর ইসলামী আন্দোলনের নামে মওদুদীসহ তার অনুসারী জামায়াত-শিবিরের নেতকর্মীরা ঈমান আক্বিদার চরম শত্রু। পবিত্র ইসলাম ধর্মে নেই কোন প্রকারের অস্ত্রবাজি, থাকতে পারবে না হানাহানি আর রক্তপাতের ঘটনা। অথচ জামায়াত ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সন্ত্রাস আর অস্ত্রবাজির মাধ্যমে তাদের প্রতিটি আন্দোলন এবং অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মওদুদীপন্থীরা তাদের লেখনির মাধ্যমে ইসলামকে বিকৃত করে আসছে। মহান আল্লাহপাক থেকে শুরু করে নবী-রাসূল, সাহাবী, অলি-আল্লাহ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কেউ জামায়াতীদের সমালোচনা থেকে বাদ পড়েনি। তাই তাদের সকল লেখা বই বাজেয়াফত করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
×