ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী চাঁইদের রাজনীতির অধ্যায় শেষ হতে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩১ আগস্ট ২০১৬

যুদ্ধাপরাধী চাঁইদের রাজনীতির অধ্যায় শেষ হতে যাচ্ছে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জামায়াতের কুখ্যাত শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অধ্যায়ের শেষ হতে চলেছে। জামায়াত অর্থ যোগানদাতা হিসেবে খ্যাত মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকর হলে সমাপ্তি হবে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটির অধিকাংশ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর উগ্র জঙ্গীবাদী রাজনৈতিক ইতিহাসের। তবে একদিকে নিষিদ্ধের গণদাবি অন্যদিকে একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির প্রেক্ষাপটে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নতুন কৌশলে এগোচ্ছে বিএনপির এ রাজনৈতিক মিত্র। প্রতিষ্ঠার পর একাধিকবার নিষিদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশী-বিদেশী মিত্রদের আশীর্বাদে চেহারা লুকাতে যুদ্ধাপরাধী নয় এমন নেতাদের সামনে এনে পুনর্গঠন করা হচ্ছে দল। নতুন আমির ও সেক্রেটারির নামও চূড়ান্ত। জামায়াতের বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, কেবল নতুন আমির আর সেক্রেটারি নির্বাচনই নয়, নিষিদ্ধ হলে প্রয়োজনে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে জামায়াত। নতুন দল হলেও গোপনে জামায়াতেরই সাংগঠনিক কাঠামো থাকবে। নতুন দলে যুদ্ধাপরাধীরা থাকলেও শীর্ষ পদে রাখা হবে তাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কোন অভিযোগ নেই। চেহারা লুকাতে ইতোমধ্যেই দলের লোগোও পরিবর্তন করা হয়েছে। শীঘ্রই তাদের দল নিষিদ্ধ হতে পারে ধরে নিয়ে সম্প্রতি দলের নীতিনির্ধারকরা নতুন দল গঠন করার সিদ্ধান্ত অনেকটাই চূড়ান্ত করেছেন। ইতোমধ্যে বিডিপি নামে নতুন দল গঠনের কথা মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের সভায় বলা শুরু করেছেন দায়িত্বশীল নেতারা। তবে এ কর্মকা-ের মাধ্যমে উগ্রবাদী এ দলটি পাকিস্তান জামাতের চেহারা লুকিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছে, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ঘটনাকে ভ-ামি হিসেবেও অভিহিত করেছেন তারা। বলছেন, এটা একটা ভ-ামি। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। জামায়াত বাহ্যিক চেহারা পাল্টে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছে তারা এখন আগের মতো নেই। বাংলাদেশের জামায়াত আসলে পাকিস্তান জামাতের একটা শাখা। তাদের লোগো ও পাকিস্তান জামাতের লোগোও এক। এখন চেহারা লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিএনপিসহ দেশী-বিদেশী গোষ্ঠী পাশে থাকায় বাইরে যতই হুঙ্কার দিক না কেন ইতিহাসের সবচেয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পড়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত উগ্রবাদী গোষ্ঠী জামায়াত-শিবির। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের আদলে প্রতিষ্ঠিত হলেও জামায়াতীরা এবার অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে। গোলাম আযমসহ কয়েক নেতার মৃত্যুর সঙ্গে আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল মুজাদিহসহ একের পর এক নেতার ফাঁসির রায়ে এ সঙ্কট ক্রমেই বাড়ছে। অধিকাংশ নেতা দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরের অনেকটা সাধারণ নেতাকর্মী দিচ্ছেন দলের নেতৃত্ব। মোনাফেক জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর তিনবার হয় নিষিদ্ধ ॥ উগ্র মৌলবাদী এই দলটির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশে সব ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। ওই দিনই নিষিদ্ধ হয় জামায়াতের রাজনীতি। সাত বছর পর জিয়াউর রহমানের বদৌলতে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ভারতের হায়দারাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের এই জামায়াতে ইসলামী। মাওলানা আবু আলা মওদুদীর প্রতিষ্ঠিত এই দলের নাম ছিল ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা যখন প্রায় নিশ্চিত ঠিক সেই সময়ও এই মওদুদী বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে এই মুহূর্তে বেশি জরুরী হলো এখানে হুকুমতের আইন প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতার কয়েকতদিন আগে ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাটনায় জামায়াতের সম্মেলন করেন মওদুদী। আগস্টে স্বাধীনতার পর মওদুদী পাকিস্তানের লাহোরে একটি বস্তিকে ‘দারুল ইসলাম’ ঘোষণা করে সেখানে অবস্থান নিতে থাকেন। এখান থেকেই দল পরিচালনা করে উগ্রবাদী সব বই-পুস্তক প্রকাশ করেন। ’৬২ সাল পর্যন্ত অন্তত ১০০ প্রবন্ধে মওদুদী বলেন, পার্লামেন্টে মহিলা সদস্য আসন নাজায়েজ। অথচ ওই বছরেই ফাতেমা জিন্নার পক্ষে নির্বাচনে তার সঙ্গে কাজ করেন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াত শাখার আহ্বায়ক করা হয় খুররম শাহ মুরাদকে। মাওলানা আব্দুর রহীম, ব্যারিস্টার কোরবান আলী ছিলেন যুগ্ম আহব্বায়ক। আব্দুর রহীম কারমাইকেল কলেজ থেকে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন গোলাম আযমকে। পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করে দলটি। আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতের কর্মকা-ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে ওই বছরেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় সরকার। ’৬৬ তে আওয়ামী লীগের ছয় দফার তীব্র বিরোধিতা করে জামায়াত। ’৭০-এর নির্বাচনে জামায়াত পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি আসনে জয়লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ডাঃ আব্দুল মালিককে গবর্নর করে যে প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়েছিল তাতে শিক্ষামন্ত্রী হয়ে আসেন জামায়াতের আব্বাস আলী খান। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে জামায়াত চালায় গণহত্যা। ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার ঘোষণা দিয়ে গঠন করা হয় ‘শান্তি কমিটি’। মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে জামায়াত নিষিদ্ধ হয়। আত্মগোপন করে গণহত্যার নায়ক জামায়াত নেতারা। ’৭৫ এ জাতির পিতার হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদে ফিরে আসে যুদ্ধাপরাধীদের দল। ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে তাদের রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেয়। এসময় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগের (আইডিএল) হয়ে কাজ চালায় জামায়াত। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে কয়েকটি পদে জয়লাভ করে আইডিএল। এই নেতাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রহীম, সিদ্দিকুর আহমেদসহ অন্যরা। ওই বছরই জিয়াউর রহমানের বদৌলতে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এলে আইডিএল ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত হয় ‘জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ’। যার ভারপ্রাপ্ত আমির হন একাত্তরের ঘাতক আব্বাস আলী খান। দলে আসেন একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী সকল জামায়াত নেতাই। এদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারাই এখন জামায়াতের শীর্ষ নেতা। সাংবিধানিকভাবে বৈধ হওয়ার আশায় গত বছরের শেষদিকে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দলের নাম পাল্টে ফেলে জামায়াত। জামায়াতে ইমলামী বাংলাদেশ নাম পাল্টে ধারণ করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির শরিক দল হিসেবে দলটি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। পরবর্তীতে চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক হিসেবে সরকার গঠন করে। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের শরিক হওয়ার পরও জামায়াত পায় মাত্র দুটি আসন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার গণদাবিতে রূপ নেয়ায় ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল যুদ্ধাপরাধীদের জন্য অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আর এই নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার পর থেকেই বেকায়দায় পরে জামায়াত। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ১৪ জনই যুদ্ধাপরাধী ॥ দলটির ১৫ সদস্যোর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ১৪ জনই সরাসরি যুদ্ধাপরাধী। এর মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী, আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ, মকবুল আহমদ, অধ্যাপক একেএম নাজির আহমদ, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ আব্দুস সোবহান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, এটিএম আজহারুল ইসলাম, আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ্জাহের, মীর কাশেম আলী, মাওলানা রফিউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও রফিকুল ইসলাম খান। এর মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধেই সরকারের হাতে আছে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার দালিলিক নানা প্রমাণ। বাকি ৩ জন নাজির, রফিউদ্দিন ও রাজ্জাকের বিরুদ্ধেও আছে যুদ্ধাপরাধের নানা অভিযোগ। রফিকুল একাত্তরে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন বলে দাবি করে দলটি। এদের মধ্যে কয়েকজনের ফাঁসি ও কয়েকজন মারা গেলেও শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসেনি এখনও। কেবল শীর্ষ নেতারাই নয়, সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলে রীতিমতো অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়বে জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অসংখ্য নেতার। দেশে বিদেশে বন্ধুহীন নিষিদ্ধের আতঙ্ক ॥ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমনকি জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, অন্তত পাঁচটি কারণে এই মুহূর্তে জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীটি। কারণগুলো হচ্ছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে একের পর এক জামায়াতের শীর্ষনেতাদের ফাঁসির আদেশ ও রায় কার্যকরের উদ্যোগ, আধ্যাত্মিক গুরু গোলাম আযমের মৃত্যু, স্বল্পসময়ের ব্যবধানে কয়েক হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং মানবতাবিরোধিতার বিচারবন্ধে ক্রমশ বিদেশীবন্ধু রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপ ও প্রভাব হ্রাস। নিবন্ধন বাতিলের সঙ্গে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগে। জনরোষের ভয়ে জোট ও ভোটবন্ধু বিএনপিও সেভাবে সমর্থন করতে পারছে না জামায়াতকে, যা জামায়াতের চিন্তার আর এক কারণ। জানা গেছে, পশ্চিমাবিশ্বের কয়েকটি দেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জামায়াতের পাশে দাঁড়িয়েছে বরাবর। পাশে আছে তুরস্ক, পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে এসব দেশের ক্রমাগত চাপের পরও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অব্যাহতভাবে হচ্ছে জামায়াতের অভিযুক্ত নেতাদের শাস্তিও। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর চাপের মুখেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্ত অবস্থানের কারণে জামায়াতের বিদেশী-চাপ কৌশল কাজে লাগেনি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরব-আমিরাত সফরের পর সরকারের অবস্থান আরও কঠোর হয়ে ওঠেছে। সব মিলিয়ে বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায় কাজ না হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছে জামায়াতের মনোবল। চলমান সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার সরকারী উদ্যোগে। এ বিষয়ে ১৪ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সরকারকে চাপও দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে জোট নেতা ও তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল এমপি বলেন, আমরা আশাবাদী খুব দ্রুত জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হবে। সরকার আন্তরিক স্বাধীনতাবিরোধী দলকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করতে। আমরা আরও সক্রিয়। দলে মতবিরোধ, সঙ্কট নেতা নির্বাচনেও ॥ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের আদলে প্রতিষ্ঠিত হলেও চরম নেতৃত্ব সঙ্কটে ভেঙ্গে পড়ছে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো। জানা গেছে, জামায়াত শিবিরের কোন সিদ্ধান্তই এখন আর ঠিকভাবে নিতে পারছে না। কর্মসূচী দিলেও আগের মতো কাজে আসছে না। গত কয়েক দিনের হরতাল ছিল নাম কাওয়াস্তে। সূত্রগুলো বলছে, বর্তমান নেতাদের মাঝে সমন্বয়হীনতায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর জামায়াতের সঙ্গে শিবিরের মতবিরোধে সিদ্ধান্ত নিতেও পারছে না উগ্রবাদী এ গোষ্ঠী। আছে গঠনতন্ত্র মানা নিয়েও মতবিরোধ। জানা গেছে, ২০০৯ সালের নবেম্বরে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে আমির নির্বাচিত হন মতিউর রহমান নিজামী। ২০১০-১২ সেশনের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১০ সালে তিনি গ্রেফতার হন। এরপর ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয় নায়েবে আমির মকবুল আহমাদকে। এরপর বিশেষ পরিস্থিতি দেখিয়ে মকবুল আহমাদের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ, ২০১২ সালের শুরুতে গঠনতান্ত্রিক নিয়ম লঙ্ঘিত হবেÑএমন মনে করে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জামায়াত। রুকন সম্মেলনে ব্যর্থ হয়ে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ প্রদর্শন করে মকবুল আহমাদকেই ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে রাখা হয়। ধারাবাহিকভাবে প্রবীণ নেতাদের পদ শূন্য হওয়ায় কমান্ডিং নেতৃত্বসঙ্কট তৈরি হয়েছে জামায়াতে। এ অবস্থায় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। সর্বশেষ তিন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায়ের পর টানা কর্মসূচী চললেও হরতাল ডেকে লাপাত্তা অধিকাংশ জামায়াত-শিবির। আবার অনেক স্থানে নাশকতার চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানে সফল হয়নি তারা। দলের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ আটক থাকায় এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে জামায়াত ও ছাত্রশিবির এ মুহূর্তে ঝুঁকি নিতে রাজি নয় বলে জানিয়েছেন মাঠপর্যায়ের নেতারা। দেশের যেসব এলাকায় জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে, সেসব এলাকায়ও হরতালে দলটির তেমন তৎপরতা ছিল না। নেতৃত্ব সঙ্কটের কারণেও আন্দোলন জোরদার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। পুনর্গঠিত হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। আগের অধ্যায় শেষ, নতুন চেহারায় ফিরছে জামায়াত ॥ রাজনৈতিক অঙ্গনে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী নেতাদের আশা বাদ দিয়েই পুনর্গঠিত হচ্ছে জামায়াত। কোণঠাসা দলটি এবার তরুণ নেতৃত্বের সমন্বয়ে পুনর্গঠিত হচ্ছে। সামনে রাখা হচ্ছে সেই নেতাদের যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে পরিচিত কম। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশোর্র্ধ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার বড় কোন অভিযোগ নেই- এমন নেতাদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অবশ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক কোন শীর্ষ নেতাকে এ মুহূর্তে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে না। কর্মী সমর্থক-ভক্ত অনুরাগী সর্বোপরি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে- এ আশঙ্কায় তাদের স্বপদে রেখেই দলকে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তবে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে সম্ভাব্য সব পথেই হাঁটছেন দলটির বর্তমান শীর্ষ নেতারা। মানবতাবিরোধী অপরাধে শীর্ষ নেতাদের মুক্তির জন্য চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখবে জামায়াত-শিবির। এ ক্ষেত্রে কিছু কৌশলী কর্মসূচীতে যাবে তারা। দলের নিবন্ধন ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না, বরং নিষিদ্ধ হবে-এ কথা ধরে নিয়েই এগোচ্ছে দলটির নেতারা। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখছেন তারা। জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, একটি মধ্যপন্থী ইসলামী দল হিসেবে আমেরিকা ও ইউরোপের মতো দেশগুলোর সঙ্গে জামায়াত সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে অনেক আগেই। এর ধারাবাহিকতায় পাশের দেশ ভারতের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় জামায়াত। এ জন্য জামায়াতের একটি কূটনৈতিক মিশন কাজ করছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব সফর করে দলের পক্ষে আন্তর্জাতিক লবিংয়ের কাজ করছেন সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। নতুন পরিকল্পনাকে সফল করতে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের আইনজীবী রাজ্জাক এ মুহূর্তে অবস্থান করছেন আমেরিকায়। ছুটে বেড়াচ্ছেন কখনও নিউইয়র্ক, কখনও ওয়াশিংটন বা ক্যালিফোর্নিয়ায়। প্রকাশ্যে তৎপর না থাকলেও ব্যারিস্টার রাজ্জাক নিভৃতে বসে নেই বলে জানা গেছে। তার সঙ্গে নিউইয়র্কের জামাতী মিডিয়া ও জামাতী মতাদর্শের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। নতুন আমির হচ্ছেন মকবুল, সেক্রেটারি ডাঃ মুজিবুর রহমান ॥ ২০১৭-১৯ সেশনের আমির হিসেবে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদই নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। আগামী ৭ দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা করবে দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। ইতোমধ্যে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। সেক্রেটারি হচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ডাঃ মুজিবর রহমান। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত মজলিসে শূরার প্রভাবশালী সদস্য এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, সদ্য আমির নির্বাচনে রুকনদের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। এই নির্বাচনে প্রায় ৯৫ শতাংশ ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন মজলিসে শূরার দায়িত্বশীল এই সূত্রটি। সূত্র জানায়, গৃহীত ভোটে মকবুল আহমাদই এগিয়ে আছেন। ভোটের বেশিরভাগ অংশ তার দিকেই গেছে। সত্তরোর্ধ মকবুল আহমাদ প্রায় ৯০ ভাগের বেশি ভোট পেয়েছেন বলে ধারণা করছেন এই সূত্রটি। গত ১৭ আগস্ট বুধবার দিনভর কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে আমির নির্বাচন কার্যক্রম শুরু হয়। সারাদেশে একযোগে ৮৩টি সাংগঠনিক জেলায় প্রায় ৩৭ হাজার রুকনের কিছু কম রুকন এই ভোট কার্যক্রমে অংশ নেয়। নতুন এই আমির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলটিতে অবসান হবে প্রায় ৬ বছরের বেশি সময়ে থাকা ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের। পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ, নির্বাহী পরিষদ, বিভাগীয় সেক্রেটারি নির্বাচন হবে। শূরা নির্বাচনের পাশাপাশি জেলা ও মহানগরী আমির নির্বাচনও সম্পন্ন হবে বলে সূত্র দাবি করেছে। জেলা ও মহানগরীর রুকনরা আমির নির্বাচনে ভোট দেবেন। চেহারা লুকানোর বৃথা চেষ্টা ॥ এদিকে এ কর্মকা-ের মাধ্যমে একদিকে উগ্রবাদী এ দলটি পাকিস্তান জামায়াতের চেহারা লুকিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছে বলে বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ঘটনাকে ভ-ামি হিসেবেও অভিহিত করেছেন তারা। একাত্তরের ঘাতক দালাল-নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলছিলেন, এটা একটা ভ-ামি। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। জামায়াত বাহ্যিক চেহারা পাল্টে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছে তারা এখন আগের মতো নেই। বাংলাদেশের জামায়াত আসলে পাকিস্তান জামায়াতের একটা শাখা।
×