ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাগাশ্রয়ী সুরে ছায়ানটে নজরুল স্মরণ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৭ আগস্ট ২০১৬

রাগাশ্রয়ী সুরে ছায়ানটে নজরুল স্মরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছুটির দিনে রাগাশ্রয়ী সুরেলা শব্দধ্বনি ছড়িয়ে গেল ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে। সাম্য, দ্রোহ, প্রেম ও মানবতার কবিকে জানানো হলো সুরের শ্রদ্ধাঞ্জলি। কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণবার্ষিকীর আগের দিন শুক্রবার শরতের সন্ধ্যায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নভাবে স্মরণ করা হয় জাতীয় কবিকে। মেলে ধরা হয় নজরুল রচনার দ্যুতিময় অধ্যায় রাগাশ্রয়ী গানের ডালি। পরিবেশিত হয় কবির অনন্য সৃষ্টির আলোময় রাগভিত্তিক গীতি আলেখ্য ‘যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম’। শ্রোতাদের সুবিধার্থে প্রতিটি পরিবেশনার আগে রাগের প্রকৃতি পাঠের পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয় রাগটির পরিচয়। উঠে আসে রাগসঙ্গীত বিষয়ক নজরুলের গবেষণাধর্মী বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিসম্ভার। প্রহরভিত্তিক আটটি রাগের সঙ্গে পরিবেশগত পরিবর্তনের বিষয়গুলো উচ্চারিত হয় সুর-তাল ও লয়ের সহযোগে। এই ৮টি রাগের বিন্যাসেই নজরুলের এই অনবদ্য গীতি আলোখ্যটি ১৯৪০ সালে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে সম্প্রচারিত হয় ‘যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম’ নামে। যাম যোজনায় কড়ি মধ্যম রাগের পরিবেশনায় শুরু হয় কবিকে স্মরণের এ সঙ্গীতাসর। অনেক কণ্ঠ মিশে যায় এক সুরে। সম্মেলক কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা গেয়ে শোনায়Ñ পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বোলে ....। রাগটির পরিচয় তুলে ধরেন ছায়ানটের সঙ্গীত শিক্ষক রেজোয়ান আলী। আর রাগটির বিবরণ মেলে ধরেন জয়ন্ত রায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাত্রি শেষ প্রহর ও দিবা প্রথম প্রহরের সন্ধি হচ্ছে এই ললিত রাগটি। দ্বিতীয় পরিবেশনায় তিন শিল্পীর একক কণ্ঠে উচ্চারিত হয় রাগ টৌড়ি। মোহিত খান গেয়ে শোনানÑ জাগো জাগো খোলো গো আঁখি....। তানভীর আহমেদ গেয়ে শোনানÑ তোমার আকাশে উঠেছিনু চাঁদ...। শ্রাবন্তী ধর পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘নয়ন মুদিল কুমুদিনী হায়’। রাগটির পরিচয় তুলে ধরেন ছায়ানটের সঙ্গীত শিক্ষক অসিত দে। আর রাগের প্রকৃতি পাঠে সুমনা বিশ্বাস বলেন, দিবা প্রথম প্রহর ও দিবা দ্বিতীয় প্রহরের সন্ধি হিসেবে এই রাগটি নির্বাচন করেছিলেন নজরুল। দ্বিতীয় প্রহর ও দিবা তৃতীয় প্রহরের সন্ধি হিসেবে গৌড় সারং নামের রাগের আশ্রয়ে উপস্থাপিত হয় তৃতীয় পরিবেশনাটি। সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয় ‘ভবনে আসিল অতিথি সুদূর’। একক কণ্ঠে জারিফ ইকরাম পরিবেশন করেন ‘ভুলিতে পারিনে তাই।’ জয়ন্ত রায়ের বিবরণে রাগটির পরিচয় তুলে ধরেন রেজোয়ান আলী। চতুর্থ পরিবেশনায় ছিল দিবা তৃতীয় ও চতুর্থ প্রহরে সন্ধি রাগ মুলতানী। নবনীতা চক্রবর্তী গেয়ে শোনান ‘বাঁশরী বাজে মুলতানী সুরে’ এবং ধ্রুব সরকারের কণ্ঠে গীত হয় ‘ভারত শ্মশান হ’ল মা’। সুমনা বিশ্বাসের পাঠে রাগ পরিচয় উপস্থাপন করেন অসিত দে। দিবাভাগের শেষ প্রহর এবং রাত্রি প্রথম প্রহরের সন্ধি রাগ পূরবীর আশ্রয়ে শুক্লা পাল সেতু পরিবেশন করেন ‘কে তুমি দূরের সাথী’। জয়ন্ত রায়ের পাঠে রাগ পরিচয় উপস্থাপন করেন রেজোয়ান আলী। রাগ ছায়ানটে সম্মেলক গানের সঙ্গে ছিল তিন শিল্পীর একক পরিবেশনা। বৃন্দ কণ্ঠে গীত হয় ‘দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে’। কানিজা হুসনা গেয়ে শোনান ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’। মনীষ সরকার পরিবেশন করেন ‘রিনিকি ঝিনিকি ঝিনি রিনি’ এবং ঐশ্বর্য সমাদ্দার ‘বনে বনে দোলা লাগে’। সুমনা বিশ্বাসের পাঠে রাগ-পরিচয় উপস্থাপন করেন অসিত দে। রাত্রি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সন্ধি রাগ বেহাগের আশ্রয়ে পরিবেশিত হয় ‘কেন দিলে এ কাঁটা’, ‘রে অবোধ শূন্য শুধু’, ‘নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে’ ও ‘নাইবা পেলাম আমার গলায়’ শিরোনামের গানগুলো। গেয়ে শোনান মির্জা বুশরা ফাতিমা, অভিজিৎ কুন্ডু, অর্পিতা সরকার ও আফসানা রুনা। রাত্রি তৃতীয় ও চতুর্থ প্রহরের সন্ধি রাগ পরজে গান শোনান সুপ্তিকা ম-ল। তাঁর কণ্ঠে গীত ‘পরজনমে দেখা হবে প্রিয়’। সম্মেলক জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে শেষ নজরুলকে স্মরণের এ সঙ্গীতানুষ্ঠান। জাতীয় কবির প্রয়াণবার্ষিকীতে নজরুল ইনস্টিটিউটের আয়োজন ॥ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউট আয়োজিত দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সূচনা হয় শুক্রবার। বিকেলে ধানম-ির নজরুল ইনস্টিটিউটে প্রথম দিনের আয়োজনে ছিল আলোচনা, নজরুল-সঙ্গীত ও আবৃত্তি এবং ৫০০ আদি সুরের গানের সিডির মোড়ক উšে§াচন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। সভাপতিত্ব করেন ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইমেরিটাস রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী, শাহ সাদিয়া আফরিন মল্লিক, সোহানী হোসেন প্রমুখ। স্বাগত ভাষণ দেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ইকরাম আহমেদ। সঞ্চালনা করেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। উদ্বোধনী আলোচনায় ফজলে নূর তাপস বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন, আমরা তাঁর সেই সম্মান ধরে রাখতে পারিনি। বর্তমানে দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক-সামাজিক সংকট তা থেকে নজরুলচর্চার মাধ্যমে উত্তরণ সম্ভব। নজরুলচর্চায় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহও আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে আশা করি। রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে প্রচারমাধ্যমসহ শিল্পীরাও নজরুলের গানের সুরের ওপর দুর্বৃত্তের মতো আচরণ করছে। সুরের বিকৃতি রোধে আমরা নজরুলের গান আদি গ্রামাফোন রেকর্ড অনুযায়ী রেকর্ড করে সিডি আকারে প্রকাশ করছি, আমাদের ওয়েবসাইটেও থাকছে সেসব গান। উন্নত সফটয়্যার ব্যবহার করে আমরা গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে মূল সুর উদ্ধার করেছি। আশা করছি, এ বছরের মধ্যেই শুদ্ধ সুরে দেড় হাজার গানের রেকর্ড সম্পন্ন হবে। নজরুলের সুর বিকৃতিকারীদের সতর্ক করে তিনি আরও বলেন, গানের বিকৃতি রোধে এখন থেকে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে নজরুল ইনস্টিটিউট। প্রসঙ্গত, প্রতিষ্ঠার পর থেকে নজরুলের গানের বিকৃতি রোধে কাজ করে যাচ্ছে নজরুল ইনস্টিটিউট। এরই মধ্যে আদি গ্রামাফোন রেকর্ডের দেড় হাজার গান সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব গান থেকে ৫০০ গান নিয়ে শুক্রবার কবির ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশ করেছে ১০টি সিডি। এতে অংশ নিয়েছেন ১২০ জন শিল্পী। সাংস্কৃতিক পর্বে নজরুলের রচনা থেকে আবৃত্তি করেন মাহিদুল ইসলাম। এছাড়াও আবৃত্তি করেন লায়লা আফরোজ। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন ইউসুফ আহমেদ খান, নিশাত আহমেদ, মনিকা রানী দাস, ইশরাত জাহান মিম ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শিল্পীবৃন্দ। এ আয়োজনের অংশ হিসেবে আজ শনিবার বিকেল ৪টায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে রয়েছে আলোচনা, নজরুল পুরস্কার প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আক্তারী মমতাজ। সভাপতিত্ব করবেন নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইমেরিটাস রফিকুল ইসলাম।
×