ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যকর পদক্ষেপ

সতর্কতামূলক ব্যবস্থার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমেছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩১ জুলাই ২০১৬

সতর্কতামূলক ব্যবস্থার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমেছে

শাহীন রহমান ॥ বিশ্বে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও অধিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কারণে দেশে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের চেয়ে এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ার পাশাপাশি জনগণকে সতর্ক করতে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে এখন আবহাওয়া অধিদফতর থেকে প্রতিনিয়ত সিগন্যালিং ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে। এছাড়া এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দিলে উপকূল এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনার ত্বরিত ব্যবস্থা আগের চেয়ে এখন অনেক উন্নত। এছাড়া দুর্যোগের সময়ে লোকজনকে আশ্রয় দেয়ার জন্য উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে অনেক। এ কারণেই ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হলেও সবশেষ রোয়ানুতে মারা গেছে মাত্র ২৭ জন। দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, ১৯৭০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশে বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৯বার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে ১৯৭০ সালের ১২-১৩ নবেম্বর। দেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণ ও সম্পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় ছিল সেটি। হারিকেনের তীব্রতা নিয়ে প্রচ- বাতাস দু’দিন ধরে বারবার আঘাত হানে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানউদ্দিনের উত্তরাঞ্চল, চর তজিমুদ্দিন, মাইজদির দক্ষিণাঞ্চল ও হরিণঘাটায়। স্মরণকালের সর্বাপেক্ষা বেশি জীবন, সম্পদ ও ফসলের ধ্বংস সাধন হয় এ দুর্যোগে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। ৩৮ হাজার সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭৭ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ২০ হাজারের বেশি মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সম্পদ ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক। দশ লাখেরও বেশি গবাদিপশুর মৃত্যু হয়। ৪ লাখ ঘরবাড়ি ৩ হাজার ৫শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭০ সালের এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিমি। জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মিটার। বিশেষজ্ঞদের মতে সমুদ্রের ভরা জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি সংঘটিত হওয়ায় এমন প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ১৯৯১ সালে আবার দেশের ওপর বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ওই ঘূর্ণিঝড়ে সরকারী হিসেবে মানুষ মারা গেছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৮ জন। এরপর আরও একাধিকবার দেশে আঘাত হানলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক কম। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেখানো হয়েছে ১৯৭০ সালের পর ১৯৮৮ সালে দেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। তবে ওই ঘূর্ণিঝড়ে মারা যায় ৫ হাজার ৭০৪ জন। এছাড়াও ১৯৯৭ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ৫৫০ জন, ২০০৭ সালে সিডরে ৩ হাজার ৪০৬ জন। তবে সিডরে মানুষ কম মারা গেলেও এখনও এই ঝড়ের প্রভাব রয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এখনও সিডরের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। ২০০৯ সালের আয়লায় ১৯০ জনের মৃত্যু হয়। মহাসেন আঘাত হানে ২০১৩ সালে। এ ঝড়ের প্রভাবে উপকূল এলাকায় মারা যায় মাত্র ১৭ জন। ঘূর্ণিঝড় কোমেন আঘাত হানে ২০১৪ সালে। এতে মাত্র ১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ এ বছর মে মাসে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। এতে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, উপরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি ঘূর্ণিঝড় ছিল অধিক শক্তিশালী। তবে এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে বর্তমানে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতার কারণে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ এখন সফলভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। মূলত দেশের উপকূলীয় এলাকা সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ। ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিবছর এসব জেলায় আঘাত হানে। এসব এলাকায় লোকজন প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই টিকে রয়েছে। সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতার কারণে টিকে থাকার মনোবল আগের চেয়েও অনেক বেড়েছে। যদিও তারা সব সময় প্রকৃতির এই বিরূপ পরিবেশের সঙ্গে সহাবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছে জীবন জীবিকার তাগিদেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৩২ ভাগ এলাকা উপকূলীয় অঞ্চলভুক্ত। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৪ কোটি অর্থাৎ ২৫ ভাগ লোক উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে থাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ ও ৪০ ভাগ মানুষ উপকূলীয় এলাকার ৩০ থেকে ১শ’ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করে থাকে। ঘূণিঝড়, ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এশিয়া প্যাসিফিক ডিজাস্টার রিপোর্ট ২০১৫ অনুযায়ী বিশ্বের অধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত ১৭৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ওই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ সব সময় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। এই তিনটি দুর্যোগের তালিকায় বাংলাদেশ ১৬২ দেশের মথ্যে প্রথম। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে শতকরা ১৫ ভাগ পরিমাণ প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়। তবে বিভিন্ন রিপোর্টে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত দেশের তালিকার কথা বলা হলেও এর বিরুদ্ধে বা দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে প্রতিবছর বন্যা সাইক্লোন আঘাত হানলে লোকজন ঠিকই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে সিগন্যালিং ব্যবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে। আইভিআর পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এই দুর্যোগের আগাম সতর্কতা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সমুদ্রগামী জাহাজ এবং সমুদ্রবন্দরসমূহের জন্য প্রতিনিয়ত আলদা সিগন্যালের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আবহাওয়া অধিদফতরের পক্ষ থেকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকেও এখন প্রতিনিয়ত প্রত্যেক নদীর পানি ত্রাস-বৃদ্ধি তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং লোকজনকে সতর্ক করা হচ্ছে। ফলে মানুষ সহজেই নিরাপদে চলে যেতে সক্ষম হচ্ছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে ইতোমধ্যে উপকূলীয় এলাকায় ১শ’ আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যয়ে ২০১৯ সালের মধ্যে আরও ২২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, মন্ত্রণালয়ের একটি জাতীয় দুর্যোগ সাড়া প্রদান কেন্দ্র ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। এই কেন্দ্র দুর্যোগের পূর্বে আগাম সতর্ক সঙ্কেত সারাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস করছে। এছাড়াও আগাম সতর্ককরণ, জরুরী সাড়া প্রদান, অনুসন্ধান ও উদ্ধার, জরুরী ত্রাণ, পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন কর্মকা- সংক্রান্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র চালু রয়েছে। তিনি জানান, এখন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীতে উপকূলীয় ১২ জেলায় ৩ হাজার ২৯১টি ইউনিটে ১৬ হাজার ৪৫৫জন মহিলাসহ ৪৯ হাজার ৩৬৫ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। এরা উপকূলীয় জেলাসমূহে আগাম সতর্ককরণ বার্তা প্রচার করে থাকেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল জানান, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এখানে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস সারা বছরই হয়ে থাকে। আগে সচেতনতার অভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ মারা যেত বেশি। সরকার এখন এসব বিষয়ে বেশ সচেতন। প্রাকৃতি দুর্যোগের অপেক্ষায় না থেকে আগেই জেলা প্রশাসনের কাছে নগদ অর্থসহ সব কিছু বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যাতে বন্যা বা প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গে তা মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছানো যায়। এছাড়া যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় মন্ত্রণালয়ের আগাম প্রস্তুতিও রয়েছে।
×