ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টার্গেট কিলিংয়ে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত

জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দিয়েছে শিবির

প্রকাশিত: ০৬:১২, ৭ জুন ২০১৬

জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দিয়েছে শিবির

শংকর কুমার দে ॥ আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত দেশের কয়েকজন রাজনীতিক ও আন্তর্জাতিক একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে তারাই চালাচ্ছে টার্গেট কিলিং। জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে যোগ দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াতের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের সদস্যরা। তারাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তাদের স্বজনদের টার্গেট কিলিং করার জন্য বেছে নিয়েছে। এর পর তারাই আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস কিংবা আল কায়েদার নামে দায় স্বীকার করে ফেসবুক বা টুইটারে বার্তা পাঠাচ্ছে। সর্বশেষ এ ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর টার্গেট কিলিংয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু ও নাটোরে খ্রীস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ। তদন্তে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে প্রশ্ন উঠেছে- প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী, ধর্মযাজক, ভিন্নমতাবলম্বীদের টার্গেট কিলিং করানোতে লাভবান হচ্ছে কে বা কারা? উদ্দেশ্যই বা কী? নিরীহ-নিরপরাধ একজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ও আরেকজন খ্রীস্টান ব্যবসায়ীকে হত্যার মাধ্যমে কাদের কাছে কী বার্তা পৌঁছে দেয়া হলো? একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রীকে হত্যাকা-ের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার বার্তা পৌঁছানো হচ্ছে কি? আর খ্রীস্টান ব্যবসায়ীকে হত্যা করে পাশ্চাত্য দেশসমূহের নাগরিকরা নিরাপদ নয়- এ বার্তা পাঠানো কি উদ্দেশ্য? বাংলাদেশ নিরাপদ নয়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, স্থিতিশীলতা নেই, বিশৃঙ্খলা চলছে- এমন বার্তা পৌঁছানোর উদ্দেশ্যেই কি টার্গেট কিলিংকে বেছে নেয়া হয়েছে? আর এর জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে ভিন্নধর্মাবলম্বী, বিদেশী, ধর্মযাজক, পুরোহিত, প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, ভিন্নমতাবলম্বীদের? বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলে মনে করেন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুনের আগেও সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার গাবতলীতে এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা ও আশুলিয়ায় আরেক পুলিশ কর্মকর্তা খুনসহ আহত হয়েছেন আরও পাঁচ পুলিশ সদস্য। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা বোঝাতে চেয়েছেনÑ এসব ঘটনায় দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে আর এ হত্যা ও হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের ডেকে এনেছে দেশীয় কয়েকজন রাজনীতিক। এ ধরনের পটভূমিতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে নিরাপত্তার ইস্যুটি। পাশাপাশি উঠে এসেছে বাংলাদেশ তথা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি। এসব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন বেশ তৎপর। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তারই ধারাবাহিকতায় ইসরাইলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি এন সাফাদি ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে দিল্লীতে বৈঠকে বর্তমান সরকার উৎখাতের জন্য মোসাদের অর্থায়ন করার বিষয়টি আলোচনা হয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ বৈঠকের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আসলাম চৈৗধুরীকেও দেখিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশে মোসাদের এজেন্টকে নিয়ে দিল্লীতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি বিএনপির অনেক নেতাই জানতেন বলে গোয়েন্দা সংস্থাকে জানান বিএনপি নেতা আসলাম। দিল্লী বৈঠকের একাধিক ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় ও হতবাক হন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে প্রথম দফায় রিমান্ডে সাত দিনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানোর পর দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ইসরাইলের মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার, জয় অপহরণ চেষ্টা বানোয়াট ইত্যাদি একের পর এক যে তোপ দাগাচ্ছে বিএনপি, তার মধ্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বিচারের রায় বানচালের ইস্যুতেও জামায়াতের প্রধান সমর্থক তুরস্ক। যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্যবেক্ষণে দুই দফায় প্রতিনিধি দল পাঠায় দেশটি। জামায়াতের সুরে তুরস্ক একাধিকবার বলেছে, বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়নি। মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রতিবাদে বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয় তুরস্ক। সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিও উষ্মা প্রকাশ করেছে তুরস্ক। সবচেয়ে অন্যতম কারণ হলোÑ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর আজীবন কারাদ- হওয়ার পর কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় বাতিলের জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোগান যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন তাও ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। এছাড়াও জামায়তের অর্থের যোগানদাতা ধনকুবের মীর কাশেম আলীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে একযোগে কাজ করছে তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জঙ্গীগোষ্ঠীর তৎপরতায় মদদদান, জাল মুদ্রা পাচারের ঘটনায় ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি রাষ্ট্রদূত তলব, প্রত্যাহার, প্রতিবাদলিপি, বিবৃতি প্রদান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন ঘটেছে তাতেও ষড়যন্ত্রের আভাস স্পষ্ট। জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা থেকে পাকিস্তানী কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে পাকিস্তানকে। পাকিস্তান কোন অজুহাত ছাড়াই পাকিস্তানে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহার করার অনুরোধ করে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করায় উভয় দেশের হাইকমিশনারকে পাল্টাপাল্টি তলবের ঘটনায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোন সময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কাটছাঁট করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে দু’দেশ। এদিকে, নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর তুরস্ক ইতোমধ্যে তাদের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওযটুককে ঢাকা থেকে ডেকে পাঠিয়েছে। পাকিস্তান ও তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজামীর ফাঁসি দেয়ায় নিন্দা ও শোক জানিয়ে বিবৃতিও প্রকাশ করে। নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পাকিস্তানের সংসদে শোক প্রস্তাব তোলা হয় এবং তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়া হয়। ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকেও এ নিয়ে গতকাল বিকেলে পাল্টা তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঢাকা থেকে পাকিস্তানের দু’জন কূটনীতিককে প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয় পাকিস্তানকে। এছাড়াও এসব ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত একাধিক বৃহৎ শক্তিধর প্রভাবশালী বিদেশী রাষ্ট্র ও তাদের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেছেন, আইএস নয়, দুটি আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিক দেশকে অস্থিতিশীল করতে টার্গেট কিলিং করছে। শীঘ্রই চট্টগ্রামে এসপির স্ত্রী হত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে। পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুনের ঘটনা টার্গেট কিলিং। এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা বাহিনী তৎপর রয়েছে। এ হত্যার সঙ্গে আইএস সম্পৃক্ত নয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
×