ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিক্রমপুরে কবি

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৮ মে ২০১৬

বিক্রমপুরে কবি

১৯৩৬ সালে ফরিদপুরে কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে ভাষণ দেন। এই সময় তিনি বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জে আসেন। মুন্সীগঞ্জ শহরের জমিদারপাড়ার সৈয়দ মোচন মিয়ার বাসভবনে রাতযাপন করেন এবং শহরের কালীমন্দির আঙ্গিনায় সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নেন। নজরুল ইসলামের গানের সুরে মুখরিত হয় মুন্সীগঞ্জ। কবির অতি সংক্ষিপ্ত সময় মুন্সীগঞ্জে আসার তথ্যটি অনেকের অজানা। তবে তথ্যাটি স্থানীয়দের অনেকে জানেন। মুন্সীগঞ্জের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন। তাঁর বাড়ির পাশেই মোচন মিয়ার বাসভবন। সেখানেই ছিলেন নজরুল। অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ করে হোসেন বলেন, নজরুলের সেই স্মৃতিটি ক্ষণিকের হলেও মুন্সীগঞ্জের জন্য গৌরবের। নজরুল একবার সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনে অংশ নেন। ময়মনসিংহ থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত ছিল তাঁর নির্বাচনী এলাকা। মুন্সীগঞ্জও ছিল এই নির্বাচনী এলাকার মধ্যেই। - মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল মুন্সীগঞ্জ থেকে মিলাদে কবি ১৯২৯ সালের ১০ মার্চ কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ে। উপলক্ষ ছিল ঠাকুরগাঁও হাইস্কুলের বার্ষিক মিলাদ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা। তখনকার দিনে মিলাদ অনুষ্ঠানটি ছিল সাড়া জাগানো ব্যাপার। বিদ্যালয়ের সকল ছাত্র, অভিভাবক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, ব্যবসায়ী এবং তৎকালীন মহকুমার নানানজনের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছিল। বিদ্যালয়ের বার্ষিক মিলাদ অনুষ্ঠানে প্রতিবারেই একজন বিশিষ্ট অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মিলাদ কমিটি ও বিদ্যালয়ের সভাপতি এসডিও ফনীভূষণ চ্যাটার্জী, প্রধান শিক্ষক সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, হেড মৌলানা নাজির আহমেদ, ছাত্র কমিটির সম্পাদক নাসির উদ্দিন এবং সহ-সম্পাদক আহমদ সিদ্ধান্ত নেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আনা হবে। ছাত্র সম্পাদক নাসির উদ্দিন ও তাঁর বন্ধু এম ইউসুফ কলকাতায় অধ্যয়নরত এক আত্মীয় রাণীশংকৈল থানার যদুয়ার গ্রামের ডা. নিযাম উদ্দিন আহমদের সাহায্যে কবির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তিনি টেলিগ্রামের মাধ্যমে নিশ্চিত করেন ১০ মার্চ কবি ঠাকুরগাঁওয়ে আসছেন। মিলাদ শেষে তখন রাত ন’টা বাজে। স্কুলের মাঠে নাটক। সেখানে আমন্ত্রণ জানালে কবি রাজি হলেন। ক্ষুদে অভিনেতাদের প্রশংসাও করলেন নাটক শেষে। কবি দলবলসহ খাবার দাবার সেরে ঘুমোতে গেলেন। পরদিন সকাল বেলা। ঘটনা ভিন্ন রকম। দিনাজপুর থেকে ডিএম এবং এসডিও জানিয়েছেন, যেন কবিকে দ্রুত ঠাকুরগাঁও থেকে কলকাতা পাঠানো হয়। ভয়ে ভয়ে একথা কবিকে জানানো হলো। যা ভয় হয়েছিল, হলোও তাই। কবি গেলেন রেগে। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন- এখানেই আরও তিন দিন থাকবেন। থাকলেনও তাই। পরদিন টাউন হলে বক্তৃতা ও গান গেয়ে শোনান। স্কুলের মাঠে আরও একদিন আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তিনি স্থানীয় কংগ্রেস কমিটির সভাতেও যোগ দেন। আজ এ বাড়ি, কাল ও বাড়ি, শুধু নিমন্ত্রণের পালা। কবি যেখানেই যান, দলবল নিয়েই যান। -এস এম জসিম উদ্দিন ঠাকুরগাঁও থেকে কবির রাজনীতি প্রেম-বিয়ে বিরহ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনে পাঁচ বার কুমিল্লায় এসে ১১ মাস ছিলেন। কুমিল্লায় তাঁর রাজনীতি, গ্রেফতার, প্রেম-বিরহ, বিয়ে, ব্যক্তিজীবন, সঙ্গীত ও সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায় কেটেছে। ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কবি নজরুল পাঁচবার কুমিল্লায় আসেন। এ সময় তিনি কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে ১১ মাসের মতো ছিলেন। এ সময়ে তিনি অজস্র কবিতা ও গান রচনা করেছেন। কবি নজরুল মুরাদনগরের দৌলতপুরে আলী আকবর খাঁর ভাগনী সৈয়দা হককে (কবির দেয়া নাম নার্গিস আশার খানম) প্রেম করে বিয়েও করেছিলেন। আবার অজ্ঞাত কারণে বিয়ের রাতেই অভিমান করে নার্গিসকে ফেলে কুমিল্লা শহরে চলে এসেছিলেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ের ইন্দ্র কুমার সেনের ভাতিজী আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দুলীকে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় অবস্থানের সময়ে তাঁর প্রেম-বিরহ, সাহিত্য-কবিতা-গান রচনাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝিতে সাংস্কৃতিক কর্মকা- শুরু হয়। দেশ বিভাগের পর কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে শুরু হয় নজরুল চর্চা। এর আগে ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শহরের ঈশ্বর পাঠশালায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি ও নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণের অংশ হিসেবে ১৯৬২ সালে শহরের কেন্দ্রবিন্দু কান্দিরপাড় থেকে ফরিদা বিদ্যায়তন পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয় নজরুল এভিনিউ। ১৯৮৩ সালে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমানের উদ্যোগে কুমিল্লা শহরের রাণীর দীঘিরপাড়, রাজগঞ্জ, মুরাদপুর, বাদুরতলা, ঝাউতলা, দারোগা বাড়ি, সার্কিট হাউস সড়ক, চর্থা এলাকার শচীন দেব বর্মণের বাড়িসহ শহরের যেসব স্থানে কবি নজরুলের অবস্থান ও বিচরণ ছিল সেসব স্থানে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে জেলা প্রশাসক হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী কবি নজরুলের অবস্থান ও ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে স্থায়ীভাবে পাকা স্মৃতিফলক স্থাপন করেন। এসব স্মৃতিফলকের মধ্যে নজরুল এভিনিউর পশ্চিম দিকে প্রবেশ মুখের উত্তর পাশে বসন্ত মজুমদারের বাড়ির সামনের ফলকটির গা ঘেঁষে আছে সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন। কবির শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়ির সামনের ফলকটি ভালভাবে পড়তে হলে মাটিতে বসতে হয়। এ ফলকের উত্তর পাশে ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনের ফলকটি সারাক্ষণই মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্স বা রিকশা চালকদের আড্ডার আড়ালে পড়ে থাকে। ঝাউতলায় উকিল যোগেন্দ্র চন্দ্রের বাড়ির সামনের ফলকটি এখনও কোনরকমে টিকে রয়েছে নির্মাণাধীন বড় ভবনের সামনে। দারোগাবাড়ি মাজারসংলগ্ন যে বাড়িতে কবি গানের আসর বসাতেন, সেখানে বারান্দার ভেতরের দেয়ালে স্থাপিত ফলকটি এখন আর সচরাচর দর্শনার্থীর চোখে পড়ে না। মুরাদপুর মৌলভীপাড়ার জানে আলম চৌধুরীর বাড়িতে স্থাপিত ফলকটি দূর থেকে চোখে পড়ে না। চর্থা এলাকায় খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মনের বাড়িটি ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়ে নজরুলের স্মৃতিফলকও বিলীনের পথে চলে গেছে। রাজগঞ্জ সড়কের যেখান থেকে কবি নজরুল পুলিশের হাতে প্রথম আটক হয়েছিলেন সেখানেও ছিল নজরুল স্মৃতিফলক। বর্তমানে রাজগঞ্জের সেই ফলকটির অস্তিত্ব নেই। -মীর শাহ আলম, কুমিল্লা থেকে
×