ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

বিলুপ্তির পথে টিভি ও অন্য প্রচলিত গণমাধ্যম

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৮ মে ২০১৬

বিলুপ্তির পথে টিভি ও অন্য প্রচলিত গণমাধ্যম

॥ দুই ॥ যারা সাম্প্রতিককালের খবরাখবর রাখেন তারা জানেন যে, এখন সরাসরি ইন্টারনেটে টিভি সম্প্রচার করতে প্রযুক্তিগত কোন সমস্যাই নেই। আমি নিজে অনেক ইন্টারনেট টিভি প্রতিষ্ঠানের ফিতা কেটেছি। আরও আধা ডজন টিভি কেন্দ্র ইন্টারনেট টিভি হিসেবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় আছে। অন্যদিকে প্রচলিত টিভিগুলোকেও সরাসরি অনলাইন সম্প্রচারের পথে পা রাখতে হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইন্টারনেটে সম্প্রচারিত টিভি দেখার জন্য টিভি সেটের কথা ভাবাই দরকার নেই, যদিও আজকালের টিভিগুলো ইন্টারনেট কম্পাটিবল হয়েছে। মোবাইল থেকে পিসি যাই হাতের কাছে যা মানুষকে ইন্টারনেটে যুক্ত করে সেটিই তার টিভি সেট। একই সঙ্গে কোথায় স্যাটেলাইট আছে, কোথায় তরঙ্গ পেলাম বা পেলাম না সেইসব ভাবনার চাইতে বড় ভাবনা হলো ইন্টারনেট সংযোগ আছে কি-না। বাংলাদেশের প্রেক্ষিত যদি ভাবেন তবে এটি মনে রাখতে হবে যে, ২০০৮ সালে যেখানে মাত্র ১২ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ২০১৬ সালে সেটি ৬ কোটির ওপরে উঠেছে। আগামী পাঁচ বছরে সম্ভবত জনসংখ্যার এমন কেউ থাকবে না যার নাগালের মাঝে ইন্টারনেট থাকবে না। বাংলাদেশে যারা এখনও প্রচলিত টিভি মাধ্যমের লাইসেন্স নিয়ে মারামারি করছেন তারা হয়তো এই রূপান্তরটি অনুভব করতে পারছেন না। অন্যদিকে যারা ইন্টারনেট টিভির পাশাপাশি স্যাটেলাইটেও টিভি সম্প্রচার করতে চান তাদেরকে এখন আর ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র বা ফ্রিকুয়েন্সি বা তরঙ্গ বরাদ্দ নেবার দরকার নেই। ইন্টারনেট সেই কাজটিও করে ফেলেছে। আপনি আপনার ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে সম্প্রচারের উপাত্ত পাঠিয়ে দিতে পারেন। দুনিয়ার যে কোন প্রান্ত থেকে সেটি স্যাটেলাইটে উঠে যেতে পারে। আমরা ক্রমান্বয়ে দুনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মাধ্যমটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আমরা একটু ব্যাখ্যা করে দেখতে চাই যে প্রচলিত টিভি বা সম্প্রচার ব্যবস্থা পুরোই কি রূপান্তরিত হবে। ইদানীং এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে যে ফেসবুক বা ইউটিউব টিভিকে বিলুপ্ত করে দেবে বা টিভির জায়গা দখল করবে। যে টিভি নিজে কাউকে বিলুপ্ত করতে পারেনি সে অন্যের হাতে বিলুপ্ত হবে? অনুষঙ্গটি বড়ই জটিল। অনেকেই হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক যখনই কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বা সেই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কেউ বক্তব্য রাখেন তখন তিনি তার মোবাইলটাকে সেলফি বা মাইক স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে তার বা বক্তার সামনে বসিয়ে রাখেন। কখনও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা মোবাইলটিকে বক্তার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না ব্যাপারটা কি? কেউ কেউ ভাবেন ছবি তোলা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন এভাবে ভিডিও না করলে কি নয়। যারা জানেন তারা বোঝেন যে এটি কেবল ভিডিও করা নয়। পলক তার ফেসবুকে ভিডিওটিকে সরাসরি সম্প্রচার করেন। দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর মতো পেশাদারিত্ব না থাকলেও এর দর্শকসীমা হাজার হাজার বলে পলক নিজেই ঘোষণা করেন। এ রকম সুযোগ আমার এই নিবন্ধটি লেখার সময়কাল অবধি আর কেউ পান বলে আমার জানা নেই। পলকের ফেসবুক হিসাবের হিসাবটা পাওয়া গেলে বোঝা যাবে যে তার ফেসবুক লাইভ কতবড় একটি গণমাধ্যম। পলকের ৫ হাজারের মতো বন্ধু আছে। এর বেশি বন্ধু নেয়ার ক্ষমতা কারও নেই। কিন্তু ৬ মে ১৬ তার অনুসরণকারী ছিল ১৫৩২৫৬ জন। একটি ভেবে বলুন আমাদের প্রচলিত গণমাধ্যমের কয়টি পলকের সমপরিমাণ দর্শকের কাছে পৌঁছানোর সক্ষমতা রাখেন। যারা পলকের মতো তারা নিজেরাই যে এক একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গণমাধ্যমে পরিণত হচ্ছেন সেই বিষয়টি আমাদের ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। ফেসবুক লাইভ এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এই সম্পর্কে মিডিয়ার খবর হচ্ছে এ রকম : “বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের লাইভ ভিডিও সম্পর্কে মাধ্যমটির সিংহভাগ ব্যবহারকারী অল্প-বিস্তর অবগত। ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ প্রায়ই বিভিন্ন লাইভ ভিডিও পোস্ট করে থাকেন। জাকারবার্গের পাশাপাশি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই ফিচারটি ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফিচারটি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ফিচারটি এখনও পর্যন্ত অল্প কিছু মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ। কয়েকদিন আগে ফেসবুক ঘোষণা দিয়েছিল এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাড়তি সুবিধা সংযোজনের জন্য আপাতত ফেসবুকের গবেষণাগারেই রয়েছে এটি।” কিন্তু কতদিন এই প্রযুক্তি জাকারবার্গের ঘরে থাকবে? কোন নিশ্চয়তা নাই যে কাল সকালেই সবার জন্য এটি উন্মুক্ত হবে না। যারা টিভির দিকে নজর রাখেন তারা জানেন যে এখনকার টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য সরাসরি সম্প্রচার কোন ব্যাপারই না। এক সময়ে বিশালাকারের ওবি ভ্যান নিয়ে গিয়ে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে হতো। এখন সম্প্রচারকগণ একটি ভিডিও ক্যামেরার সাথে ইন্টারনেট যুক্ত করে দিয়ে সরাসরি সম্প্রচার করে বসে থাকেন। অন্যদিকে স্কাইপের অহরহ ব্যবহার তো আছেই। যদিও আমাদের দেশে স্যাটেলাইট টিভি স্টেশনগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান তথাপি দেশের নতুন জোয়ারের নাম সম্প্রচার টিভি। টেকশহর ডট কম থেকে ২২ এপ্রিল ১৬ সংগ্রহ করা খবরটিতে আরও বলা হয়েছে, “প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফেসবুকের এই ফিচারটি গণমাধ্যমের গতিধারাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করবে। পাল্টে দেবে অনেক কিছু। মোদ্দাকথা, গণমাধ্যমের জন্য একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ফেসবুক লাইভ। ফেসবুক লাইভের প্রভাবের কারণে বিলুপ্তির পথে বসতে পারে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ইন্টারনেটভিত্তিক মিডিয়া কোম্পানি বাজফিড’র প্রেসিডেন্ট জন স্টেইনবার্গ ফেসবুকের লাইভ স্ট্রিমিংকে টেলিভিশনের জন্য বড় হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাজফিড’ও ইন্টারনেটে লাইভ ভিডিওভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করে। এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে সপ্তাহে পাঁচ দিন অন্তত এক ঘণ্টা করে লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করছে। এ বছরের শেষের দিকে লাইভ ভিডিও প্রচারের পরিমাণকে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টায় উন্নীত করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। জন স্টেইনবার্গ বলেন, ফেসবুক লাইভ ভিডিও দিয়ে গণমাধ্যমের নতুন একটি ধারা তৈরি করছে। যা দ্রুত অনেক বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সবাই এ ধরনের মিডিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফেসবুকের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোও লাইভ ভিডিওর দিকে দিনে দিনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তিনি আরও বলেন, লাইভ ভিডিও টেলিভিশনের জায়গা দখল করবে। আমি মনে করি দীর্ঘ সময় জুড়ে এই লাইভ ভিডিও রাজত্ব করবে, যতদিন পর্যন্ত আরও উন্নত কোনো প্রযুক্তি না আসে। সম্প্রতি ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী এফ-৮ ফেসবুক ডেভেলপারদের কনফারেন্সে চ্যাটবক্সকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি জানিয়েছেন, এতে যুক্ত করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অর্থাৎ এটি চলবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। চ্যাটবক্স হচ্ছে একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম। ফেসবুক এটির নাম দিয়েছে মেসেঞ্জার প্লাটফর্ম। বক্সে আসা বিভিন্ন মেসেজের উত্তর এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিতে পারে। এজন্য এটি মানুষের কণ্ঠ নকল করে থাকে। লাইভ ভিডিওর পাশাপাশি ফেসবুকে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ৩৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলের ভিডিওও। শনিবার এইচবিও চ্যানেলের টিভি প্রোগ্রাম গেম অব থ্রোনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি ৩৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলের ভিডিও আপলোড করা হয়। যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশিবার ভিউ হয়ে রেকর্ড গড়েছে। লাইভ ভিডিও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মিলিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম টেলিভিশনের অনেক শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে তৈরি হচ্ছে। সবকিছু বিশ্লেষণ করে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে ভিডিও কেন্দ্রিক সম্প্রচার মাধ্যমে রাজত্ব করবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাইভ ভিডিও। ফেসবুকে সরাসরি ভিডিও সম্প্রচার করতে পারার মানে দাঁড়াবে যে দেশে ২২ এপ্রিল ২০১৬ এর হিসাবে রাতারাতি ২ কোটি টিভি চ্যানেল গড়ে উঠবে। স্যাটেলাইটে বছরে ২৫ লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে একটি সম্প্রচার ব্যবস্থার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ¦ী হয়ে উঠবে এই ফেসবুক। হয়ত প্রশ্ন উঠবে এসব চ্যানেল আদৌ কি পেশাদার টিভির বিকল্প হবে। প্রথমে যখন ইউটিউব চালু হয় তখন তাকে ঠাট্টা তামাশা হিসেবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু এখনকার কি অবস্থা? টেক শহরেরই আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের চেয়ে ভিডিও শেয়ারিংয়ের সামাজিক মাধ্যম ইউটিউব বিজ্ঞাপন ৮০ শতাংশ বেশি কার্যকর। ইউটিউবের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান গুগল ও তাদের গবেষণা সহযোগী প্রতিষ্ঠান মার্কেটশেয়ার আটটি দেশের ৫৬টি কেস স্টাডি করে এ তথ্য জানিয়েছে। গুগলের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, টেলিভিশনে একটি বিজ্ঞাপন দিতে যে পরিমাণ খরচ হয়, তার চেয়ে ৬ গুণ কম খরচ হয় ইউটিউব বিজ্ঞাপনে। ফলে ইউটিউবে অনেক বেশি বিজ্ঞাপন দেয়া যায়। আর ইউটিউব বিজ্ঞাপনের কার্যকারিতাও অনেক বেশি। গুগলের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ম্যাট ব্রিট্টিন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, আটটি দেশে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি বাড়াতে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের চেয়ে ইউটিউব বিজ্ঞাপন বেশি কার্যকর।” টেক শহরের খবরেই আছে, “মার্কেটশেয়ারের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার লুসিয়েন ভ্যান ডার হোভেন জানান, গবেষণায় আমরা দেখেছি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিতে টেলিভিশন বেশ প্রভাব বিস্তার করে আসছে। তবে এসব দেশে বিভিন্ন কারণে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। গুগল ও মার্কেটশেয়ারের গবেষকরা টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে আরও বেশি বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক টিভি মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান থিনবক্সের গবেষণা ও পরিকল্পনা পরিচালক ম্যাট হিল এ সম্পর্কে বলেন, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ খরচ হয়, বর্তমানে সে তুলনায় ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায় না। অপরদিকে, ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে অনেক বেশি সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এ সময় টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের গুরুত্বের কথাও তুলে ধরেন হিল। তিনি বলেন, টিভি বিজ্ঞাপন অবশ্যই অনেক বেশি মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পারে। এবং সর্বোচ্চ মুনাফা দিতে পারে। তবে এজন্য টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের মান আরও বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে বিনিয়োগও।
×