ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়েই চলে উপকূলের জীবন

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

রুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়েই চলে উপকূলের জীবন

বৈশাখ মানে একদিকে যেমন ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো সবকিছু তছনছ করা রুদ্র প্রকৃতি, আরেকদিকে- এ সময় থেকে উপকূল অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সমুদ্রগামী জেলেরা বছরের এ সময়টাকে প্রস্তুতি লগ্ন হিসেবে বেছে নেয়। চৈত্রে ফেলে আসা বছরের সব দেনা-পাওনা মিটিয়ে বৈশাখে শুরু হয় নবযাত্রা। জেলেরা পুরোদমে নেমে পড়ে মাঠে। পুরো বর্ষা সমুদ্রে কাটানোর উদ্দেশ্যে চলে নানামুখী কর্মযজ্ঞ। উপকূলীয় অঞ্চলের ভূ-গঠন, আবহাওয়া, পরিবেশ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। এখানকার প্রকৃতির আচরণও আলাদা। বৈশাখে সাগরে প্রবাহিত হয় দখিনা বাতাস। যা বয়ে আনে শীতল পরশ। একই সঙ্গে দীর্ঘ ৫/৬ মাস ঘুমিয়ে থাকা সাগর দখিনা বায়ুর স্পর্শে জেগে ওঠে গর্জন করে। বৈশাখ মানেই সাগর ওঠে ফুলে ফেঁপে। বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে সৈকতে। বাতাস যত জোরে বয়, সাগর ততই হিংস্র হয়ে ওঠে। সাগরের এ রুদ্র আচরণ বর্ষা জুড়ে থাকে। উপকূলের মানুষ প্রকৃতির এ রূপের সঙ্গে মানিয়েই জীবন-জীবিকার উপায় খুঁজে নেয়। বাংলার চিরন্তন এ ধারা থেকে উপকূলের মানুষের বেরিয়ে আসার উপায় নেই। তাই বৈশাখ মানেই সমুদ্র নির্ভর জেলেদের প্রস্তুতিকাল। উপকূল ভাগের কম-বেশি ১৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। পরোক্ষভাবে নির্ভর মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। বছরের এ সময়টাতে সমুদ্রগামী জেলেদের প্রতিটি দিন কাটে প্রচ- ব্যস্ততায়। নদী ও সাগর তীরে বসে নৌকা ও ট্রলারের হাট। উপকূলের প্রায় প্রত্যেকটি ঘাটে গেলে দেখা মেলে কাঠ মিস্ত্রীদের। যারা হাতুড়ির ঠুকঠাক শব্দে তৈরি করছে নৌকা-ট্রলারের পাটাতন কিংবা খোল। করাতের হিস হিস শব্দে মিলছে কাঠের জোড়া। বিশাল আকৃতির সমুদ্র চলাচল উপযোগী একেকটি নৌকা কিংবা ট্রলার নির্মাণে কম করে হলেও এক-দেড় মাস সময় লাগে। এ সময় কাঠ শ্রমিক কিংবা মিস্ত্রীদের ফুরসত একেবারেই মেলে না। বর্ষা এলে কাজে ব্যাঘাত হবে, এ আশঙ্কায় রাতদিন চলে কাজ। নৌকা-ট্রলার হাটের কাছাকাছি দেখা মেলে আরেক পেশাজীবী গোষ্ঠীর। যারা ‘জালবুনিয়ে’ হিসেবে পরিচিত। নায়লনের সুতা দিয়ে তারা অবিরাম বুনে চলেছে জাল। ঘরবাড়ি, হাটবাজার থেকে শুরু করে গাছের ছায়ায় জাল বুনিয়েদের বসে মিলনমেলা। আজকাল বহু জেলে মেশিনে তৈরি জাল ব্যবহার করে। কিন্তু হাতে বোনা জালের কদর অভিজ্ঞ জেলেদের কাছে অনেক বেশি। জাল-নৌকা ছাড়াও জেলেদের নিতে হয় নানা ধরনের প্রস্তুতি। পুরনো জাল জোড়াতালি দেয়া। নৌকায় অন্যান্য সরঞ্জাম তোলা। খাবার-দাবারের সংস্থান করা। লোকলস্কর যোগাড় করা। এমন হাজারও কাজে পুরো বৈশাখ সমুদ্রগামী জেলেদের ব্যস্ত থাকতে হয়। বৈশাখ উপকূলের মানুষের জীবনের সঙ্গে আরও একটি কারণে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তা হচ্ছে- কালবৈশাখী। যতই ক্ষতি হোক, কালবৈশাখী লেপ্টে আছে উপকূলের মানুষের জীবনের সঙ্গে। চৈত্র থেকে বঙ্গোপসাগরে স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া বয়ে যায়। এ বাতাস দেশের উষ্ণ আবহাওয়ায় প্রবেশ করলে তা ক্রমে উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে যা প্রচ- ঝড়ে রূপ নেয়। এটি কালবৈশাখী ঝড়। সাধারণত কালবৈশাখী বিকেলের দিকে হয়। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এর রূপ কখনও কখনও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কালবৈশাখী ঝড় যখন সাগরে তৈরি হয়, তখন তা মাঝে মাঝে ঘূর্ণিঝড়েও রূপ নেয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস বরাবরই ঘূর্ণিঝড় মৌসুম। এটি উপকূলের চিরন্তন আবহাওয়া। এর সঙ্গে মানিয়ে চলাই জীবন। Ñশংকর লাল দাশ গলাচিপা থেকে
×