ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছায়ানটের বর্ষবরণ প্রস্তুতি

আপন আত্মাকেই বলতে চাই জাগো উদ্ভাসিত হও

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১০ এপ্রিল ২০১৬

আপন আত্মাকেই বলতে চাই জাগো উদ্ভাসিত হও

মোরসালিন মিজান ॥ সন্জীদা খাতুনের অদ্ভুত সুন্দর সেই লেখাটি থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক। পহেলা বৈশাখ ভোরে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে অহর্নিশ এই সংগ্রামী লিখেছেন- ‘সূর্য অন্ধকারকে বিদূরীত করে। মানুষ আলোর পিয়াসী। আমরা আলোকের ঝর্ণাধারায় অন্তরকে ধুয়ে নিতে চেয়েছি, অন্তরের যে ধুলার আস্তরণ তা মোচন করতে চেয়েছি, একে কোন বিশেষ মতের ধর্মাচরণ বলে জানি না, মানি না। মানব সমাজের অভিসার তো আলোর অভিমুখেই। এর জন্য বিশেষ কারো বন্দনা করার প্রয়োজন দেখি না- আপন আত্মাকেই আমরা বলতে চাই- জাগো- উদ্ভাসিত হও।’ হ্যাঁ, এমন মহৎ উদ্দেশ্যই নববর্ষের আরও অনেক আয়োজন থেকে ছায়ানটের আয়োজনটিকে আলাদা করেছে। স্বতন্ত্র উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলা বছরের প্রথম দিনে বাঙালীর সবচেয়ে সুন্দর শুরুটা হয় ছায়ানটের সঙ্গে। বাঙালী সংস্কৃতির চর্চার আলোকিত প্রতিষ্ঠান রমনা বটমূলে আয়োজন করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। দীর্ঘকাল ধরে চলা অনুষ্ঠানটি এখন ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ছাড়া পহেলা বৈশাখের শুরুটা কল্পনা করা যায় না। এবারও বছরের প্রথম দিন ভোর বেলায় রাজধানী শহরের সব পথ গিয়ে মিশবে চিরচেনা সবুজ উদ্যানে। বাঙালী সংস্কৃতির সমৃদ্ধি, বাঙালী সংস্কৃতির শক্তিকে সচেতনভাবে তুলে ধরবে ছায়ানট। গান কবিতা ও পাঠ ছাড়াও, অস্থির এই সময়ে বাঙালীর জন্য থাকবে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। বড় আয়োজন। বিস্তর পরিকল্পনা। সঙ্গত কারণেই লম্বা প্রস্তুতির দরকার হয়। গত কয়েক মাস ধরেই চলছে সে প্রস্তুতি। পরিকল্পনা মতো সব কাজ এগিয়ে নিতে গলদঘর্ম কর্মীরা। সন্ধ্যা হতেই বৈশাখের সুরে বেজে উঠছে ছায়ানট ভবন। দেড়শর মতো শিল্পী মিলে গাইছেন সম্মেলক গান। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে চলছে রিহার্সাল। সমকালকে গভীর পর্যবেক্ষণে নিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য গান নির্বাচন করা হয়েছে। গানে গানে মানবতার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরবে ছায়ানট। জোর দিয়ে বলবে, মানুষের কথা। তবে কোন কোন গান থেকে নিয়ে এই মর্মবাণী প্রচার করা হবে তা এখনই প্রকাশ করতে নারাজ প্রতিষ্ঠানটি। খোঁজ নিয়ে কিছু সম্মেলক গানের কথা নিশ্চিত হওয়া গেছে। কবিগুরু থেকে গাওয়া হবে- আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে।/ কে আছ জাগিয়া পুরবে চাহিয়া,/ বলো ‘উঠ উঠ’ সঘনে গভীরনিদ্রগমনে...। অপর গানটি- আমি ভয় করব না ভয় করব না।/ দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না...। নজরুল থেকে নেয়া হয়েছে- বল ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ, নব যুগ ঐ এলো ঐ/ এলো ঐ রক্ত যুগান্তর রে...। আর ওই যে বলা হয়েছিল, মানবতার কথা, সেই জায়গায় লালনের কোন তুলনা কি হয়? এই সাধক পুরুষের রচনা থেকে শিল্পীরা গাইবেন- সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কী রূপ/ আমি দেখলাম না দুই নজরে...। এমন আরও কিছু সম্মেলক গান গাওয়া হবে মঞ্চে। থাকবে ছায়ানটের শিক্ষকদের একক পরিবেশনা। প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারাও। এমন উর্বর আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারাকে সৌভাগ্য মানছেন শিল্পীরা। তাদের একজন গায়িকা শারমিন সাথী ময়না। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ছায়ানটের আয়োজনটি শুধু ছায়ানটের হয়ে নেই। এটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এর জন্য সারা বছর আমরা অপেক্ষা করে থাকি। কোন না কোনভাবে যুক্ত থাকার চেষ্টা করি। এই থাকতে পারা অত্যন্ত আনন্দের। গর্বের। মহড়া কক্ষে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি অনেকেই ছুটছেন রমনায়। অশ্বত্থ গাছের বিশাল শাখা প্রশাখার নিচে যে মঞ্চ, সেটি কেমন হবে, তার পরিকল্পনা করছেন। মূল অনুষ্ঠানের আগে এখানেই অনুষ্ঠিত হবে চূড়ান্ত রিহার্সাল। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই বৃক্ষকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হচ্ছে বর্ষবরণ উৎসবের মঞ্চ। কয়েকটি সারিতে পা ভাঁজ করে বসবেন শিল্পীরা। অনুষ্ঠান শুরু হবে ভোর সোয়া ৬টায়। প্রথমেই থাকবে রাগসঙ্গীত। সকাল বেলার উপযোগী রাগসঙ্গীত গাইবেন শিল্পীরা। এক ঘণ্টার মতো চলতে পারে সকাল বেলার গান। পরবর্তী গানগুলোতে বিশেষভাবে বলা হবে মানবতার কথা। মানুষের পক্ষে বলা হবে। সকল অশুভ অপশক্তির বিরুদ্ধে নির্ভয় থাকার আহ্বান জানানো হবে। উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করবেন শিল্পীরা। শেষাংশে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা করবেন বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন। এরপর সকলে মিলে দাঁড়িয়ে গাইবেন জাতীয় সঙ্গীত। দেশের প্রতি এই প্রেমের কথা জানিয়ে শেষ হবে ১৪২৩ বঙ্গাব্দ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। আয়োজন প্রসঙ্গে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবারের মতোই একটি সুন্দর আয়োজন নিয়ে রমনায় থাকতে চাই আমরা। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। কয়েক মাস আগে থেকেই চলছিল প্রস্তুতি। এখন আমরা শেষ পর্বে আছি। ছায়ানটের শিল্পীকর্মীরা যে যার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। এবারের আয়োজনের থিম সম্পর্কে তিনি বলেন, একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালিত হবে। এবার মানবতার বাণী সমৃদ্ধ গানের ওপর জোর দিচ্ছি আমরা। কারণ দেশে এবং বহির্বিশ্বেও এখন এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই যে অস্থিরতা, মানুষে মানুষে বিভেদ, আমরা চাই না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এমন হুমকির মুখে। মানবিক মূল্যবোধ মার খাচ্ছে। এ কারণেই প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘মানবতা’। মানবতার জয়গান করেই বছরের প্রথম দিনটিকে স্বাগত জানাবে ছায়ানট।
×