ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত ক্যাসিনো অপারেটরদের নামে মামলা হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৬ এপ্রিল ২০১৬

রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত ক্যাসিনো অপারেটরদের নামে মামলা হবে

রহিম শেখ ॥ ফিলিপিন্সে চুরি করে নেয়া বাংলাদেশের রিজার্ভের পুরো ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আদায়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ক্যাসিনো ও জাংকেট অপারেটরদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মামলা করবে মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষ (এএমএলসি)। আগামী সপ্তাহেই এই মামলা করা হবে বলে অর্থ চুরির বিষয়ে সিনেটে মঙ্গলবারের শুনানিতে জানিয়েছেন এএমএলসির নির্বাহী পরিচালক জুলিয়া বাকে-আবাদ। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মূল হোতাদের এখনও চিহ্নিত করা না গেলেও, কার কাছে কিভাবে এ অর্থ গেল, সেই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছে ফিলিপিন্সের ব্লু রিবন সিনেট কমিটি। কমিটির চতুর্থ দফা শুনানিতে, জেরার মুখোমুখি করা হয় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের। তবে, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মিলেছে তাদের কাছ থেকে। ব্যাংকটির সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো শুনানিতে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে ব্যবসায়ী জগতের বড় বড় খেলোয়াড়রা জড়িত। এর মধ্যে কিম অং-ই সেই ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার পেয়েছিলেন এবং এ্যাকাউন্ট থেকে তুলেছিলেন। তবে অং নিজের স্বীকারোক্তিতে মায়ার দাবি অস্বীকার করে বলেন, তিনি মায়ার কাছে শুধু শুহুয়া গাও নামের একজন ডিপোজিটরকে পাঠিয়েছিলেন। শুনানিতে কিম অংয়ের দাবি, চুরি হওয়া ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার রয়েছে ফিলরেমেই। তবে ফিলরেম বলছে, পেসোতে রূপান্তরিত করা চুরির কোন টাকাই তাদের কাছে নেই। এর আগে এএমএলসির কাছে আরও প্রায় ১ কোটি ডলার ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন অং। অন্যদিকে শুনানিতে সমন জারি করা দুই চীনা নাগরিক শুহুয়া কাও ও দিং জিজ উপস্থিত হননি। সিনেট ধারণা করছে, তারা পালিয়েছে। তবে এই প্রথমবারের মতো শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দু’জন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। মঙ্গলবার এএমএলসি সিনেট কমিটিকে জানায়, রিজাল ব্যাংকে থাকা ফিলরেমের দুটি হিসাব জব্দ করা হয়েছে। যেখানে পাওয়া গেছে ২৯ হাজার ফিলিপিনো পেসো। এ নিয়ে ফিলিপিন্স কর্তৃপক্ষের কাছে সব মিলিয়ে ৫৫ লাখ ডলার জমা পড়েছে। শুনানিতে মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষ (এএমএলসি) নির্বাহী পরিচালক জুলিয়া বাকে-আবাদ বলেন, ফিলিপিন্সে চুরি করে নেয়া বাংলাদেশের রিজার্ভের পুরো ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আদায়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ক্যাসিনো ও জাংকেট অপারেটরদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মামলা আগামী সপ্তাহেই করবে। তিনি বলেন, আমরা এর মধ্যেই আবেদনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করছি আগামী সপ্তাহেই এই (বেসামরিক সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ) মামলা করতে পারব। ফিলিপিন্সে এই ধরনের মামলায়, অবৈধ সম্পদ ব্যবহার করা হয়েছে এমন প্রমাণ পেলে সরকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। সেক্ষেত্রে সম্পদের মালিকের আইনী লড়াইয়ের অধিকার থাকবে। কিন্তু তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, তার সম্পদ বৈধ অর্থ থেকে এসেছে। মঙ্গলবারের শুনানিতে সানসিটি গ্রুপ জাংকেট ও গোল্ডম্যান জাংকেট নামে দুই ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ উপস্থিত ছিল। এছাড়া আরসিবিসি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধি, অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল, ফিলরেম সার্ভিস কর্পোরেশন, ফিলিপাইন এ্যামিউজমেন্টের প্রতিনিধিরা শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। মুখোমুখি দিগুইতো এবং কিম অং ॥ দিগুইতো হলেন ফিলিপিন্সের মাকাতি সিটির সেই জুপিটার স্ট্রিট শাখার সাবেক ম্যানেজার যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া টাকাগুলো লেনদেন হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। আর দিগুইতোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, চুরি যাওয়া অর্থগুলো জমা রাখা ও তোলার সুবিধা করতে ৫ জনের নামে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট করে দিয়েছেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে দিগুইতো বলেন, এক্ষেত্রে কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা তিনি জানেন না। আগের শুনানিতে দিগুইতো দাবি করেছিলেন, অং-ই তার সঙ্গে অভিযুক্ত চার ব্যাংক ডিপোজিটরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সে চারজন বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লেনদেন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দিগুইতো আরও বলেছিলেন, অং আরসিবিসি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সিইও লরেঞ্জো তানের বন্ধু। আর সর্বশেষ শুনানিতে দিগুইতোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অং। তার দাবি, তিনি কেবল শুহুয়া গাও নামে এক ডিপোজিটরকে সাবেক ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। গাও একজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী বলে সে সময় উল্লেখ করেন তিনি। ৯৮ লাখ ডলার ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি কিম অংয়ের ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৫১ লাখ ডলার ফেরত পাওয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেছে ফিলিপিন্স সিনেট। এদিকে মঙ্গলবার সিনেট শুনানিতে এন্টি মানি লল্ডারিং কাউন্সিলকে ৩০ দিনের মধ্যে আরও প্রায় ৯৮ লাখ ডলার ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং। শুনানিতে ব্যবসায়ী কিম অং বলেন, তিনি চুরি হওয়া ওই অর্থের মধ্যে আরও ৯৭ লাখ ৩৪ হাজার ৮৯০ ডলার ফিরিয়ে দিতে চান। তবে অর্থ যোগাড় করতে ১৫ থেকে ৩০ দিন সময় চেয়েছেন কিম। এর আগে দুই দফায় ৫৪ লাখ ৬০ হাজার ডলারের মতো ফেরত দেন তিনি। জড়িত ‘রাঘবোয়াল’ আমি শুধু দাবার চাল-দিগুইতো ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে ব্যবসায়ী জগতের বড় বড় খেলোয়াড়রা জড়িত। তিনি শুধু চাকরির উন্নতির লোভে পরিণাম বিবেচনা না করেই এই অপরাধে জড়িয়ে গেছেন। রিজার্ভ চুরির অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে ফিলিপাইন সিনেট কমিটির চতুর্থ দফা শুনানিতে এমন কথাই বলেছেন রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) মাকাতি সিটির জুপিটার শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মাইয়া সান্তোস দেগুইতো। মঙ্গলবার রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট চুরি অর্থ ফিলিপিন্সে এনে ভাগাভাগি নিয়ে আরও তথ্য জানতে এ শুনানির আয়োজন করে সিনেট কমিটি। বক্তব্যে দিগুইতো বলেন, ফিলিপিন্সে এনে চুরির প্রায় ৪ বিলিয়ন পেসো বিলি-বণ্টনের অপরাধের সব দায় যেভাবে আমার ওপর চাপানো হয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে মধ্যম সারির একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে আমি অনেক ক্ষমতাধর! শুনানিতে লিখিত বক্তব্যে চাকরিচ্যুত এ ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, সত্যিকার বিবেচনায় এ ধরনের উঁচু মার্গের অপরাধ সংগঠন তখনই সম্ভব যখন এ কাজে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের কেউ জড়িত থাকেন। একই সঙ্গে একাধিক দেশে ওই ব্যবসায়ীর যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি থাকতে হবে। দিগুইতো বলেন, পরিনাম না বুঝেই আমি নিজেকে ঘটনায় জড়িয়েছি। এটাও ঠিক যে, কাজটা সম্পন্ন করে ব্যাংক ম্যানেজার হিসেবে আমি আমার কর্মদক্ষতা প্রমাণ করতে এবং পেশায় এগিয়ে যেতে চেয়েছি। স্বামীর পাশাপাশি পরিবারকে সহায়তার জন্য চেয়েছি চাকরিতে আরও উপরের পদে যেতে। কর্মজীবী প্রত্যেক মায়ের এ আকাক্সক্ষা যৌক্তিক বলেই মনে করেন তিনি। রিজার্ভের কোন টাকা নেই বলে ফিলরেম কর্পোরেশনের ॥ ফিলিপিন্সের রেমিটেন্স ফার্ম ফিলরেম সার্ভিস কর্পোরেশন জানিয়েছে, তাদের কাছে বাংলাদেশের চুরি যাওয়া রিজার্ভের কোন টাকা নেই। চুরি যাওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের ১৭ থেকে ১৮ মিলিয়ন ডলার ফিলরেমের কাছেই ছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সিনেট ব্ল রিবন কমিটির শুনানিতে ফিলরেমের মালিক মাইকেল বাওতিস্তা বলেন, আমার কাছে ১৭ মিলিয়ন ডলার নেই। সিনেট প্রো টেম্পর রালফ রেক্টোর প্রশ্নের জবাবে এমন কথা বলেন তিনি। ফিলরেমের প্রেসিডেন্ট বাওতিস্তার স্ত্রী সালুদ বলেন, রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার মায়া সান্তোসের কথায় ওয়েকাং জু নামে একজনকে ৬০০ মিলিয়ন পেসো এবং ১৮ মিলিয়ন ট্রান্সফার করেছি আমরা। শুনানির শুরু থেকেই সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন বলে দাবি করেন বাওতিস্তা। সঙ্গে তিনি এটাও বলেন, আমরাই প্রথম বলেছি, বাংলাদেশের চুরি যাওয়া অর্থ যদি আমাদের কাছে থেকে থাকে তাহলে ১০ মিলিয়ন পেসো (ফিলিপিন্স মুদ্রা) বাংলাদেশকে ফেরত দিব। ‘কিন্তু টাকাটা আমরা রাখিনি, টাকা আমাদের সঙ্গে নেই।’ আবারও শুনানিতে একই কথা বলেন তিনি। অবশ্য এর আগের শুনানিতে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করছিল দুজনেই। তাই কমিটির চেয়ার সিনেটর টিওফিস্টো গুইনগোনা বলেন, মনে হচ্ছে আমাদের বোকা বানানো হচ্ছে। এদিকে, এ অর্থ পাচারে জড়িত ফিলরেমের আরও ২টি এ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে এএমএলসি।
×