ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিষিদ্ধ কথকতা -মিলু শামস

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নিষিদ্ধ কথকতা   -মিলু শামস

ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারের মৃতদেহকে চূড়ান্ত অসম্মান দেখাতে কবর দেয়া হয়েছিল পতিতাদের কবরস্থানে। যে সমাজ ব্যবস্থা সযতেœ পতিতাবৃত্তি টিকিয়ে রাখে সেখানে তারাই নিকৃষ্টতম জীব। ভলতেয়ারের যোগ্যস্থান তাই সেখানেই নির্ধারণ করেছিল ফরাসী রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানরা। তার অপরাধ তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানকে যাজক প-িত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-ির বাইরে এনে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একা নন ফরাসী এনসাইক্লোপিডিস্ট আন্দোলনের দার্শনিকদের লক্ষ্যই ছিল জনগণকে শিল্প-সাহিত্যে, দর্শন-কলায়, বিজ্ঞানে শিক্ষিত করে পরিপূর্ণ ও উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা। এ প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র ও চার্চের কাছ থেকে আঘাত এসেছে বার বার। এনসাইক্লোপিডিস্টরা তাতে দমেননি। সতেরো শ’ ঊনষাট সালে ভলতেয়ারের ‘কাঁদিদ’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চার্চ এবং রাষ্ট্র বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য একাযোগে তেড়ে আসে। জনগণের জেগে ওঠাকে ভয় পাওয়া এ দুই প্রতিষ্ঠানই মনে করে বইটি তাদের বিপক্ষে যাবে। কিন্তু নিষিদ্ধ ঘোষণার আগেই বিক্রি হয় এর তিরিশ হাজার কপি। বইয়ের বার্তা পৌঁছে যায় সাধারণের কাছে। শার্ল বোদলেয়ার, তলস্তয়, জেমস জয়েস, এ্যালেন গিন্সবার্গ, মাহমুদ দারবিশসহ বিশ্বের বহু খ্যাতিমান লেখকের বই বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ হয়েছে। উনিশ শ’ একানব্বই সালে ব্রেট স্টোন এলিসের উপন্যাস ‘আমেরিকান সাইকো’ নিষিদ্ধ হয়। অপরাধ, পুঁজিবাদী সভ্যতার নগ্ন রূপ উদ্ঘাটন করা। পশ্চিমা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল এ বই। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা এর ওপর সেন্সর আরোপ করে। জার্মানিতে নিষিদ্ধ ছিল উনিশ শ’ পঁচানব্বই থেকে দু’হাজার পাঁচ সাল পর্যন্ত। নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে বাংলা বইও। ব্রিটিশ ভারতে আঠারো শ’ ছাপ্পান্ন সালে জারি হওয়া অশ্লীলতা আইনে প্রথম বাজেয়াফ্ত হয় ‘বটতলার বই’। এরপর ‘বিদ্যাসুন্দর।’ বিদ্যাসুন্দরের প্রকাশক বিক্রেতারাও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয় উনিশ শ’ আটষট্টি সালে। টানা আঠারো বছর মামলা চলার পর উনিশ শ’ পঁচাশি সালে সুপ্রীমকোর্টের রায়ে অভিযোগ মুক্ত হয় প্রজাপতি। প্রকাশের দু’বছর পর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’র জন্য একই অভিযোগে অভিযুক্ত হন বুদ্ধদেব বসু। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ নিষিদ্ধ হয়েছিল তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সমিতির ওপর প্রভাব পড়ার অজুহাতে। প্রেসে অভিযান চালিয়ে এ বইয়ের পাঁচ হাজার কপি বাজেয়াফ্ত করেছিল ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ। আর নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদ- ভোগ করেছিলেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য। উনিশ শ’ পঁচাত্তরে ভারতে জরুরী অবস্থা জারির পর নতুন করে নিষিদ্ধ হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার।’ রবীন্দ্রনাথের পঁচিশটি গানও নিষিদ্ধের তালিকায় ছিল এ সময়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদের লেখা। এবার বইমেলায় নিষিদ্ধ হলো শামসুজ্জোহা মানিকের সঙ্কলিত একটি বই। মেলায় তার বদ্বীপ প্রকাশনের স্টলও সিল করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভাই ও প্রকাশকসহ হাতকড়া পরিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তাকে। তার অপরাধ সম্পর্কে দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ জানায়, ‘তার সংকলিত বইয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ধর্মীয়গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কাসহ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা হয়েছে। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অজ্ঞাতনামা আসামিদের কাছে থাকা বইয়ের কপি উদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে।’ এখানেও সেই রাষ্ট্র আর ধর্মের দোহাই। যেমন এ দোহাই দেয়া হয়েছিল এনলাইটেন্মেন্টের সেই যুগে ভলতেয়ারকে। জারের রাশিয়ায় লিও তলস্ততয়কে, রাষ্ট্র এবং ধর্মরক্ষক চার্চ থেকে। তাহলে কতটুকু এগুলো মানব সমাজ? সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত। কিন্তু যে গণতন্ত্রের নামে সভ্য সমাজ গদ গদ সেখানেও কেন স্বাধীন মতপ্রকাশের গতিরোধ হবে? হলেও প্রতিবাদ হবে না কেন? কারণ তন্ত্রের পরিবর্তন হলেও ক্ষমতার ভিত্তির ধারাবাহিকতা থেকে যায়। বিশ্ব এখন যে উৎপাদন ব্যবস্থায় চলছে গণতন্ত্রের অর্থকে তা একপেশে করে তুলেছে। এক শতাংশকে পুষ্ট আর নিরানব্বই শতাংশকে বঞ্চিত করার যে গণতন্ত্র তা টিকিয়ে রাখতে পুরনো কলকব্জার পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন কলকব্জা। আবির্ভাব হয়েছে নানা তত্ত্বের। দেশে দেশে এসব তত্ত্বের রক্ষক হিসেবে গজিয়ে উঠেছে তত্ত্বের উদ্গাতা ওই এক শতাংশের উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবীর দল। বহুজাতিক বিভিন্ন কর্পোরেশন ও তথ্য মাধ্যমের চাপিয়ে দেয়া কর্মসূচী, পণ্য, অভ্যাস, মূল্যবোধ ইত্যাদিকে প্রতিষ্ঠা ও সুললিতভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যাদের অন্যতম দায়িত্ব। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। তাদের প্রতিবাদী চরিত্র হারিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পুঁজি নিয়ন্ত্রকদের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে। সেজন্য একজন প্রবীণ লেখক, গবেষককে দাগী আসামির মতো হাতকড়া পরিয়ে রিমান্ডে নিয়ে গেলে এবং একটি বইয়ের অজুহাতে মেলায় স্টল বন্ধ করে দিলেও তাদের কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বেরোয় না। তারা বরং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন প্রভাবশালী শিল্পপতি, মন্ত্রী বা আমলার পাশে দাঁড়িয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কোন লেখকের উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচন করতে। নিষিদ্ধ করে কোন বইয়ের প্রচার আসলে বন্ধ করা যায় না। বিশেষ করে আজকের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নততর বিকাশের যুগে। সেই আঠারো উনিশ শতকেই তা সম্ভব হয়নি। তলস্তয়ের বড় গল্প ‘দ্য ক্রয়েৎসার সোনাটা’ নিষিদ্ধ হয়েছিল আঠারো শ’ ঊননব্বই সালে। অর্থোডক্স চার্চ এ বই নিষিদ্ধ করেছিল অশ্লীলতা ও সামাজিক সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হবে এ অজুহাতে। ডিভোর্সহীন অভিজাত রুশ সমাজে আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব দাম্পত্য সম্পর্ক, বছরের পর বছর পারস্পরিক ক্লান্তিকর জীবন টেনে নেয়ার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কেন্দ্রীয় চরিত্র পজ্দন্যুশেভ স্ত্রীকে হত্যা করে। তার মতে কেবল সমাজ সভ্যতার দোহাই দিয়ে অন্তঃসারশূন্য সম্পর্ক সারাজীবন বয়ে নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে পাগল হওয়া, আত্মহত্যা অথবা একজন অন্যজনকে হত্যা করা ছাড়া মিথ্যা বন্ধনের নিগড় থেকে মুক্ত হওয়ার আর কোন পথ থাকে না। খুনের দায়ে মৃত্যুদ- হলেও মানসিক ভারসাম্য হারানো পজ্দন্যুশেভকে বিচারক মানবিক কারণে মুক্তি দেন। পজ্দন্যুশেভের বক্তব্য ও উপলব্ধি সে সময়ের রুশ সমাজের বাস্তব চিত্র হলেও তাকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনকে ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তবে নিষিদ্ধ করার আগেই এ বইয়ের লাখ লাখ কপি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। পাঠকের ভালবাসায় ধন্য এ বই আজও বার বার পড়ে আপ্লুত হওয়া যায়, কেননা, সমাজে আজও ওই অন্তঃসারশূন্যতার অস্তিত্ব পুরোমাত্রায় আছে। জোর করে কোন কিছু দাবিয়ে রাখা যায় না। সমাজে ক্ষোভ থাকলে তার বহির্প্রকাশ কোন না কোনভাবে হবেই। গ্রেফতার, হয়রানি, হত্যা দিয়ে একে আটকে রাখা সম্ভব নয়।
×