ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চরম ভোগান্তি

ভিসা মিলছে না থাইল্যান্ড যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও আমিরাতের

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ভিসা মিলছে না থাইল্যান্ড যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও আমিরাতের

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা পেতে সমস্যায় পড়েছেন বাংলাদেশীরা। বেশ কিছুদিন ধরে এসব দেশের ভিসা পেতে বাংলাদেশীরা নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এসব দেশের ভিসা সহজীকরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। তবে ভিসা সহজে না পাওয়ায় চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, পর্যটন ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনেকেই চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। গত দুই মাস ধরে থাইল্যান্ডের ভিসা খুব সহজেই মিলছে না। সে কারণে থাইল্যান্ডের ভিসা নিয়ে জটিলতা নিরসনে দেশটির সঙ্গে বৈঠক করবে বাংলাদেশ। আগামী সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় এই বৈঠকের বিষয়ে সরকার থেকে প্রস্তুতি চলছে। এদিকে থাইল্যান্ডের ভিসা সহজে না মেলার কারণে এখন ভিসার আবেদন হ্রাস পেয়েছে। আর ভিসা না পাওয়ায় অন্যদের সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক রোগী বিপাকে পড়েছেন। ভিসা আবেদনের পর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও থাইল্যান্ডের ভিসা মিলছে না। ইতোমধ্যেই প্রায় ২৫ হাজার আবেদনকারী ঢাকার থাইল্যান্ড দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করে পাসপোর্ট জমা দিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তারা ভিসাও পাচ্ছেন না, আবার পাসপোর্ট ফেরতও পাচ্ছেন না। এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ব্যাংককে বাংলাদেশের থাইল্যান্ডের দূতাবাসে প্রতিনিয়ত অভিযোগ আসছে। সমস্যা সমাধানে থাইল্যান্ডের ঢাকা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। থাইল্যান্ডের ভিসা না পাওয়া ও পাসপোর্ট আটকে থাকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেছে। সহজে কেন থাইল্যান্ডের ভিসা মিলছে না, সে বিষয়টি জানতে চাইছে বাংলাদেশ। সে কারণে এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তও জোগাড় করা হচ্ছে। বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ঢাকার থাইল্যান্ডের দূতাবাসের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে সরকার। ঢাকার পাশাপাশি ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকেও বিষয়টি নিয়ে থাইল্যান্ড সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তুতি চলছে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই ভিসার বিষয়টি নিয়ে থাইল্যান্ড দূতাবাসের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রাথমিকভাবে আলাপ হয়েছে। সেই আলাপে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে এবার বৈঠকে বসতে চায় সরকার। গত দুই মাস ধরে থাইল্যান্ড দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন জমা দিয়ে কোন ভিসা মিলছে না। এদের মধ্যে রোগী, ব্যবসায়ী, পর্যটক, শিক্ষার্থীও রয়েছেন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিকিৎসার জন্য ভিসা আবেদন জমা দিয়েছেন। তবে তারা থাইল্যান্ডের ভিসা পাচ্ছেন না। আবার পাসপোর্ট ফিরিয়ে নিয়ে অন্য দেশেও চিকিৎসার জন্য যেতে পারছেন না। আবার অনেক রোগীই থাইল্যান্ডে নিয়মিতভাবে চেকআপ করতে যান। নিয়মিতভাবে নির্ধারিত চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নেয়ার জন্যই অধিকাংশ রোগী অন্যত্র চিকিৎসা নিতেও পারছেন না। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন রোগীরা। থাইল্যান্ডে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশীরা নিয়মিত যান। অধিকাংশ বাংলাদেশী পর্যটক হলেও রোগীর সংখ্যাও প্রচুর। কেননা থাইল্যান্ডে বেশ কয়েকটি উন্নতমানের হাসপাতাল রয়েছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার চেয়ে এসব হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সে কারণে চিকিৎসার জন্য অনেক রোগীই নিয়মিত থাইল্যান্ডে যাতায়াত করেন। ভিসা না পাওয়ায় এসব রোগীরাই এখন সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন। চিকিৎসার বিষয়টি মানবিক বিবেচনার নেয়ার জন্য থাইল্যান্ডের কাছে বিশেষভাবে তুলে ধরতে চাইছে সরকার। এদিকে আবেদনের পর ঠিক কী কারণে ভিসা দেয়া হচ্ছে না তারও কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিচ্ছে না থাই দূতাবাস। এছাড়া পাসপোর্ট আটকে রাখার বিষয়েও কিছু বলছে না। এমনকি থাইল্যান্ডের ভিসা প্রসেসের জন্য নির্দিষ্ট এজেন্ট ভিএফএস গ্লোবালও আবেদনকারীদের পাসপোর্ট ও ভিসা না দেয়ার বিষয়ে কিছু জানাতে পারছে না। সাধারণত তিন থেকে চার কর্ম দিবসের মধ্যে থাইল্যান্ডের ভিসা পাওয়া যায়। সে কারণে অনেকেই থাইল্যান্ডে বেড়াতে যান। আবার চিকিৎসার জন্যও থাইল্যান্ডে যান অনেকেই। তবে গত বছর ডিসেম্বর থেকে ভিসা নিয়ে জটিলতা তৈরি করেছে থাই দূতাবাস। ডিসেম্বর মাসে থাই দূতাবাসে নতুন একজন ভিসা কর্মকর্তা এসেছেন। তার যোগদানের পর থেকেই এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় দুই মাস ধরে আবেদনকারীরা বলতে গেলে কোন ভিসা পাচ্ছেন না। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ভিসার জন্য যারা আবেদন করেছেন এবং পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন তার মধ্যে গড়ে ১০ ভাগ আবেদনকারীর পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়েছে। বাকি ৯০ ভাগ পাসপোর্টই আটকা পড়ে আছে দূতাবাসে। ফলে এসব আবেদনকারীর মধ্যে যারা চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যেতে চেয়েছিলেন তারাই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। আর ভিসা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়ায় নতুন করে কেউ ভিসার আবেদন করতেও ভরসা পাচ্ছেন না। ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, থাইল্যান্ডের ভিসার জন্য প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক আবেদন জমা পড়ে ভিএফএস গ্লোবাল সেন্টারে। কী কারণে পাসপোর্ট আটকা আছে সে বিষয়েও ভিএফএসের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোন জবাব মিলছে না। তারা কখনও বলছেন প্রসেসিংয়ের কাজ হচ্ছে, কখনও বলছেন তদন্ত চলছে। থাই ভিসা নিয়ে জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে রোগীদের পক্ষ থেকে অনেকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছেন। আর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কারও কারও ভিসা প্রাপ্তি বা পাসপোর্ট ফেরতের জন্য থাই দূতাবাসে সুপারিশ করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, থাই ইমিগ্রেশন বিভাগ ভিসা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। যে কোন ভিসার আবেদন ব্যাংকক থেকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। আবেদনের প্রতিটি কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। কনস্যুলার শাখায় নতুন দুজন কর্মকর্তা ভিসা প্রক্রিয়া সম্পাদনের কাজ করছেন। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে ভিসা প্রক্রয়া সম্পন্ন করতে তারা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছেন। ফলে ভিসা পেতে দেরি হচ্ছে। তাছাড়া প্রায় তিন মাস ধরে থাই দূতাবাসে কোন রাষ্ট্রদূত নেই। আগামী মাসের আগে ঢাকায় নতুন রাষ্ট্রদূত আসারও সম্ভাবনা নেই। দূতাবাসে এখন একজন কাউন্সিলর চার্জ দ্য এফেয়ার্সের দায়িত্বে আছেন। ফলে ভিসা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে থাইল্যান্ডের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন, বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে ভিসা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। এদিকে থাইল্যান্ডের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের ভিসাও সহজে মিলছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশীদের জন্য যুক্তরাজ্যের ভিসা কার্যক্রম দিল্লী থেকে পরিচালিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের যাওয়ার জন্য বাংলাদেশীদের ভিসার আবেদন ঢাকা ও সিলেটে জমা ও প্রদান কার্যক্রম চললেও ভিসার মূল সার্ভার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দিল্লী থেকে। যুক্তরাজ্যের ভিসা আবেদনকারীরা অভিযোগ করেছেন, ভিসা কার্যক্রম দিল্লী থেকে পরিচালিত হওয়ার পর ভিসা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে যুক্তরাজ্য সরকার থেকে বলা হয়েছে, তাদের সরকারের খরচ কমানো লক্ষ্যে ভিসার সার্ভার দিল্লীতে নেয়া হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশের ভিসা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ভিসা পেতে কোন সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছিল যুক্তরাজ্য। তবে ভিসা কার্যক্রম দিল্লীতে নেয়ার পর থেকেই যুক্তরাজ্যের ভিসা হ্রাস পেয়েছে। অনেকেই যুক্তরাজ্যে সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য ভিসা আবেদন করে অনুষ্ঠানের নির্ধাারিত তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পরে ভিসা পাচ্ছেন। সে কারণে নির্ধারিত অনুষ্ঠানেই যোগ দিতে পারছেন না। ঢাকায় নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার এ্যালিসন ব্লেকের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম সাক্ষাতের সময়েই ভিসার বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তোলা হয়। সে সময় ব্রিটিশ হাইকমিশনার ভিসা সহজীকরণের বিষয়ে আশ্বাস দেন। সিঙ্গাপুরে ২৬ জন বাংলাদেশী নাগরিককে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর। তারপর থেকেই সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে দেশটি। তারা বাংলাদেশীদের ভিসার ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়িয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক জাহাজ কোম্পানিগুলোতে নিয়োগ পাওয়ার পরে বাংলাদেশী নাবিকরা বিশেষায়িত ভিসা পাচ্ছেন না। সাধারণ ভিসা নিয়েই তাদের সিঙ্গাপুরে যেতে হচ্ছে। নাবিকরা বিশেষায়িত ভিসা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এ সমস্যা সমাধানে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড এক্সপোতে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে প্রথমে সমর্থন না করায় ক্ষুব্ধ হয় দেশটি। পরে অবশ্য বাংলাদেশ তাদের সমর্থন দেয়। তবে প্রথমে সমর্থন না দেয়ার জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে ভিসা কমিয়ে দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। অবশ্য ঢাকায় আরব আমিরাত নতুন একটি ভিসা সেন্টার চালু করেছে। সে কারণে ভিসা সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ।
×