ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা

বিউটি বোর্ডিংয়ে ষাটের দশকের সংগ্রামী তরুণদের মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিউটি বোর্ডিংয়ে ষাটের দশকের সংগ্রামী তরুণদের মিলনমেলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ষাটের দশকের সেই সংগ্রামী তরুণরা আনন্দ আর আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন। দিনভর হাসি, খোশগল্প, আড্ডা, স্মৃতিতে বিভোর ছিলেন তারা। ফিরে গিয়েছিলেন সেই মিছিল-সংগ্রামের পুরনো দিনে। সেই সময়ের তরুণ সতীর্থরা আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। বাংলাবাজারের শ্রীশ দাস লেনের বিউটি বোর্ডিং। আজ কারও কাছেই আর অপরিচিত নয়। বাঙালীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে যেন বিউটি বোর্ডিং। আর শুক্রবার বিউটি বোর্ডিংয়ে প্রায় শতাধিক স্বাধীনতা সংগ্রামীর মিলনমেলা দেখা যায়। ষাটের দশকে যারা রাজপথ কাঁপাতেন। যাদের সঙ্গে মিছিল আর সংগ্রামে দেখা হতো প্রতিদিন, তারাই বহুদিন পর বিউটি বোর্ডিংয়ে জড় হয়েছিলেন। এতদিন পর দেখা পেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন, আবার অনেকে আবেগাপ্লতও হয়েছিলেন। শীতের সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন তারা। দুপুরে এক সাথে খাওয়া ও বিকেলের চায়ের কাপের সঙ্গে পুরো দিনটিই যেন ছিল তারুণ্য দীপ্ত বয়োজ্যেষ্ঠদের। ষাটের দশকে যে সংগ্রামী তরুণরা ছিলেন, তাদের আজ বয়স হয়েছে। তবে তারুণ্যের সেই দিন সকলেই স্মরণ করলেন। ষাট দশকের বিভিন্ন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত তারা এখানেই পার করেছিলেন। ‘৬৩-এর নির্বাচন, ‘৬৬-এর ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তারা এখানে আসতেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তারা। আজ তারা বিভিন্ন পেশা ও দায়িত্বের কারণে নিয়মিত যোগাযোগ না করতে পারলেও চেতনায় তারা একই আদর্শের। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকেই লালন করেন তারা। ষাটের দশকের ঢাকা নগরের সংগ্রামী সতীর্থদের দিনব্যাপী এ মিলনমেলার পৃষ্ঠপোষকতা করেন সাবেক ডিআইজি ফিরোজ কবীর মুকুল। আড্ডা ও গল্পের এই আসরে ছিলেন অভিনেতা প্রবীর মিত্র, বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্রনায়ক ফারুক, সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, গাজী গোলাম দস্তগীর, রাজনীতিবিদ মোস্তফা মহসিন মন্টু, শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, ফকির আলমগীর, পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়। দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছাড়াও হুমায়ুন কবির শেলী, ডাঃ আবদুল কাইয়ুম লস্কর, এ্যাডভোকেট সাইফুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ ছিলেন আড্ডায়। সুদীর্ঘ সময় পর নিজের অঙ্গনে পার করা সেই চেনা মানুষগুলোকে আবারও একত্রে পেয়ে বোর্ডিংটিকেও যেন অন্যরকম লাগছিল। ঠিক যেন ষাটের দশকে পার করা সেই সময়েই আছেন তারা। বিউটি বোর্ডিংয়ের ছোট্ট প্রাঙ্গণ সারাদিনই মুখরিত ছিল ষাটের তারুণ্য দীপ্তদের আড্ডায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের নক্ষত্রদের এ যেন এক অভূতপূর্ব মিলনমেলা। আনন্দ আড্ডার মাঝে মাঝে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন সেই সময়ের সংগ্রামী তরুণরা। পুরনো দিনের সেই স্মৃতি তুলে ধরে চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, বিউটি বোর্ডিংয়ে বসেই ষাটের দশকের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের পরিকল্পনা আমরা করতাম। জগন্নাথ কলেজ ও কায়েদ এ আজম কলেজের ছাত্ররা এখানে আড্ডা দিতেন। এই দুই কলেজের ছাত্ররা নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে যুক্ত হতো। এখানকার সেই সংগ্রামের ইতিহাস অনেকেরই অজানা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন কর্মসূচীর ঘোষণা দিলে আমরা সেটা সফলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম। সেই সময়ে মোনায়েম খানের গু-াবাহিনী এনএসএফ থেকে আমাদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করত। তবে আমরাও তাদের ছেড়ে দিতাম না। তিনি বলেন, অনেক সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে, তাই এই অর্জন আমাদের ধরে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে। সেই সময়ের সংগ্রামের স্মৃতি তুলে ধরে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ষাটের দশকে আমরা সবাই ছিলাম তরুণ নেতা। তখন আমাদের মনে ছিল বিদ্রোহ। বিউটি বোর্ডিংয়ে বসেই আমরা আন্দোলনের পরিকল্পনা করতাম। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করতাম। এখন অনেক হাইব্রিড নেতা আছেন, তবে তখন কোন হাইব্রিড নেতা ছিলেন না। সকলেই ছিলেন প্রকৃত নেতা। দেশপ্রেমের কোন অভাব ছিল না। শিল্পী ফকির আলমগীর বলেন, ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের আন্দোলনের কথা না বললেই নয়। সেই আন্দোলন দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তখন রাজনীতিতে সংস্কৃতি ছিল, আর সংস্কৃতিতে ছিল রাজনীতি। এখন সেটা নেই। অভিনেতা প্রবীর মিত্র বলেন, সেই সময়ে আমাদের বিউটি বোর্ডিংয়ে না আসলে পেটের ভাত হজম হতো না। বিউটি বোর্ডিংই ছিল আমাদের প্রাণ। এখানে এসে আড্ডা দিতাম। আন্দোলন সংগ্রামের পরিকল্পনাও করতাম। এখন বয়স হয়েছে। তবে ফিরোজ কবির মুকুল সবাইকে এনে আড্ডার আয়োজন করেছে, এটা ভাল লাগছে। সবাইকে পেয়ে সেই পুরনো দিনের কথা আজ বেশ মনে পড়ছে। রাজনীতিবিদ মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ষাটের দশকের বিভিন্ন আন্দোলনে তরুণরা যুক্ত হয়েছিলেন। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বিউটি বোর্ডিংয়ে বসে আন্দোলনের অনেক পরিকল্পনা করেছি। তাই বিউটি বোর্ডিং ইতিহাসেরই একটি অংশ বলে তিনি মনে করেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের সতীর্থদের মিলনমেলার উদ্যোক্তা সাবেক ডিআইজি ফিরোজ কবীর মুকুল। এই মিলনমেলার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠ’কে বলেন, কয়েক বছর ধরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি। সেই সময়ে যারা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন তাদের একত্র করার চেষ্টা করছি। সবাই এখানে আসার পর আমরা সেই পুরনো দিনে ফিরে যাই। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মধ্যে ডুবে যাই। এটা আমাদের খুব ভাল লাগে। প্রতিবছরই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
×