ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

সর্বজয়া নারী : ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সর্বজয়া নারী : ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস

শরীরের মারণব্যাধি ক্যান্সারের নিশ্চিত উপস্থিতি জানতে পেরেও একজন মানুষ কী রকম সাহস আর অফুরন্ত শক্তিকে পুঁজি করে সহজভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে যেতে পারেন তা বোধগম্য নয়! তিনি হয়ত বা মানুষ নয়; তারও বেশি কিছু। চির সুন্দরের শহরে বসবাসরত সকলের মতো সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল এই জননীতুল্য দেবীর সান্নিধ্যে এসে। তাকে দেখলেই এক অপূর্ব আলো এসে ভিড় করত এক অবুঝ অথচ বিস্ময় বালকের অনুসন্ধিচ্ছু দু’চোখে। দেবাহুতি চক্রবর্তী। জন্ম সংস্কৃতির পীঠস্থান ও সৌন্দর্যের শহর রাজবাড়ীতে। পিতা নারায়ণ চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন সংস্কৃতিমনা এবং সমাজসেবক। জমিদার বংশ বলয়ের সন্তান হিসেবে পারিবারিক পরিবেশে শিল্প সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে তিনি বেড়ে ওঠেন। রাজবাড়ী কলেজের মেধাবী ছাত্রী দেবাহুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ এবং এলএলবি পাস করেন। সরকারী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। সফল ও বিজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে তাঁর সুনাম অন্ন রয়েছে। জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতির আসনও অলঙ্কিত করেছেন এক সময়। দেবাহুতি চক্রবর্তী নানা সামাজিক কর্মের মধ্যেও সংস্কৃতি চর্চা তাঁর নেশা। তাঁর উদ্যোগে শিশুদের মনোজগতের বিকাশে ‘আবোল তাবোল’ শিশু সংগঠন গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রচর্চায় নিবেদিত দেবাহুতি চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠা করেন ’রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন কেন্দ্র।’ নারী জাগরণে অগ্রণী এই মহীয়সী সব সময় বলে থাকেন, ‘মেয়েদের কোন রক্ষক সত্যিকার অর্থে কেউ নেই। আদি যুগে দেবতা-মুনি-ঋষিদের থেকে আজ অবধি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র কেউ নারীকে নিরাপদ রাখেনি। নারীর ক্ষমতায়নের লড়াই তাই বিশেষ-বিশেষ পদ আর অর্থ নয় নিজের নিরাপত্তা রক্ষার সার্বিক বলয় সৃষ্টি করাই নারীর মূল লড়াই ।’ মরণব্যাধি ক্যান্সারে-আক্রান্ত হওয়ার খবর জেনেছিলাম কিছু কাছের মানুষের কাছ থেকে বেশ কিছুদিন আগে। এমন সংবাদ শুনে মনের অজান্তেই হৃদয় কেঁপে উঠেছিল; দু’ফোটা অশ্রুও বেরিয়ে ছিল বোধহয়! ঢাকায় চিকিৎসারত অবস্থায় যখন তাকে দেখতে গেলাম, ভেবেছিলাম কেবিনে শুয়ে থাকা অসুস্থ এক দিদিকে দেখব। কিন্তু ধারণাটা উল্টো প্রমাণিত হলো। দেখলাম অপূর্ব এক মায়াময়ী দিদিকে, যে কিনা তখনও দেখতে আমাদের চেয়েও চিরতরুণ ও প্রাণশক্তির অধিকারিণী। হাস্যজ্জ্বল মুখম লে লেগে আছে প্রশান্তির চিহ্ন; দুর্বলতার লেশ মাত্র নাই চোখেমুখে। এই নারীযোদ্ধা সাত মাস একটানা কেমো আর রেডিও থেরাপির সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। চিকিৎসা নিয়েছেন দেশের বাইরে অর্থাৎ ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে। ‘আমার লড়াইয়ের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমার ধারণা স্বচ্ছ। আমি আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাক্সক্ষী সবার সহায়তায় যতটুকু টিকে থাকতে পেরেছি, সেটা আমার কাছে অনেক। সময় সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। এই অসময়ে মনে হয়, কত কাজ করার ছিল, কিন্তু তা আর হলো না।’ দিদির এই কথাগুলো কাটার মতো অন্তরে এসে বেঁধে অলক্ষ্যেই। নিজের চিকিৎসা নিতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, তা এক সময় জানিয়ে দিলেন গ্রন্থ লিখে সাধারণ মানুষের জন্য। চিকিৎসাবিদ্যার কেউ নন তিনি। তাই প্রযৌক্তিক শব্দের ভার এড়িয়ে তিনি যথা সম্ভব সহজ করে বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন ক্যান্সার কী, ক্যান্সার কেন হয়, ক্যান্সারের বৈশিষ্ট্য কী, ক্যান্সারের সতর্কতা কী, ক্যান্সারের প্রতিকার কী, ক্যান্সারের চিকিৎসাকেন্দ্র কোথায় প্রায় সবই বিধৃত হয়েছে তাঁর ‘সাথে ক্যান্সার, ক্যান্সারের সাথে’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থ নিয়ে লেখক আবু হাসান শাহরিয়ারের ভূয়সী প্রশংসার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, ’আইনজীবী হিসেবে ‘অত্র আদালতের এলাকাধীন’ লিখতে লিখতেই জীবন কেটেছে। সাত মাস একটানা কেমো আর রেডিও থেরাপির সঙ্গে যুদ্ধ করতেই কাগজ-কলম হাতে নেয়া। লেখক, কবি, সাংবাদিক সবার উপরে সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব আবু হাসান শাহরিয়ার যেভাবে তাঁর মন্তব্য তুলে ধরেছেন, আর যেভাবে অন্যরা সাড়া দিয়েছেন সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সবার শুভ কামনা একটা কথাই মনে করায়... ’সত্যের আনন্দ রূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মুরতি, এই জেনে এ ধুলায় রাখিনু প্রণতি।’ তাঁর লেখা ‘নানান পথের অগ্রপথিক’ গ্রন্থ সকলের ভূয়সী প্রশংসাও কুড়িয়েছে। মারণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে এখনও যুদ্ধ করছেন তিনি। যিনি নিজের দিকে মৃত্যুকে দ্রুত ছুটে আসতে দেখেও নির্মল হাসতে জানেন। স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে জানেন। স্বপ্ন দেখার ও দেখানোর ক্ষেত্রে কী অদম্যই না এই সবর্জয়ার মন। অথচ তিনি একসময় নিজের চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতেই হিমশিম খেয়েছেন। তবুও তিনি ভেবেছেন সমাজের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের কথা; সুন্দর এই ছোট্ট শহরটির কথা। সুন্দর এই জীবন নিয়ে, মানুষ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সবাই পারে না। যে স্বপ্ন দেখতে পারে না, জীবন তার নিকট ধূসর ও বিবর্ণ। আর আগামীর স্বপ্ন বুননের মানুষগুলোর হাত ধরেই আসবে পায়ে চলার পথ। এই স্বপ্ন দেখার মানুষ, অদম্য মানুষরা বেঁচে থাক অনন্তকাল। জয়তু মহান নারী, জয়তু দেবাহুতি চক্রবর্তী!
×