ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কার ব্যয়বহুল হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে পরিত্যক্ত মাটির কক্ষগুলো অনুমতি ছাড়াই ভাঙ্গা হয়

নওগাঁয় কবিগুরু নির্মিত স্কুলঘর ॥ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

নওগাঁয় কবিগুরু নির্মিত স্কুলঘর ॥ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে

বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ ॥ রাণীনগর উপজেলার রাতোয়াল গ্রামে অবস্থিত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ উচ্চবিদ্যালয়’টি একাধারে যেমন রবীন্দ্র নিদর্শন, তেমনি সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে তৎকালীন সময়ের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ভেঙ্গে ফেলেছে কবির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি চারটি মাটির তৈরি শ্রেণীকক্ষ! সেই সঙ্গে কক্ষের টিনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করে অর্থ আত্মসাত করারও অভিযোগ উঠেছে, ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এছাড়াও এখানে কবিগুরুর ব্যবহৃত ও স্মৃতিবিজড়িত অনেক আসবাবপত্র বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য এই পুরাকীর্তি সংস্কারের জন্য গত বছর টিআর প্রকল্পের দুই মেঃ টন চাল অনুদান দিলেও তা সংস্কার না করে পুরো ঘরটিই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আর এর অর্থ নিজেদের পকেটে তোলার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্তমান স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাবদ লাখ টাকা প্রদান ও শ্রেণী কক্ষে ২৪টি সেলিং ফ্যান স্থাপনসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজের বিবরণ লিখে এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার অনেকে অভিযোগ করে বলেন, ক্ষমতার জোরে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষক লিফলেটের বর্ণিত এই সব মিথ্যে কাজের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। প্রকৃত কাজ করলে বাড়তি টাকা খরচ করে লিফলেট বিতরণের কোন প্রয়োজন নেই বলে স্থানীয়রা মনে করেন। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কবিগুরুর স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে তারা ঘরগুলো ভেঙ্গে দিয়ে। সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮৫ সালের শুরুর দিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালীগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখাশোনার জন্য রাতোয়াল গ্রামে আসতেন। বিশ্বাস করতেন প্রজাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শিক্ষার প্রয়োজন। সে উপলব্ধি থেকেই সেই সময়ের কিছু প-িতদের সহায়তায় এই রাতোয়াল গ্রামে কবির নিজ নামে আদর্শ এই বিদ্যাপীঠের পথ চলা। সেই সময়ে ম্যানেজার শ্যামানন্দ গুহ কালিগ্রাম পরগনার এই মূল জমিদারি (পতিসর এস্টেট) দেখাশোনা করতেন এবং তার ছেলে নিত্যানন্দ গুহ (নিতাই বাবু) দেখাশোনা করতেন (সাবস্টেট) তথা এই এলাকা। তাদের সার্বিক সহযোগিতায় তৎকালীন রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলী প-িত, শমসের আলী আকন্দ, কফিল আলী আকন্দ এবং এরফান আলী আকন্দকে সঙ্গে নিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়। বিদ্যালয়টি তৎকালীন সময়ে আজিজুল্লাহ্ আকন্দের বৈঠকখানায় শুরু হলেও পরবর্তীতে রবীন্দ্র এস্টেটের নিজস্ব সম্পত্তির ওপড় মাটির ঘর নির্মাণ করা হয়। তখন হেড প-িত হিসেবে রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলী প-িতের ওপর বিদ্যালয়টির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। পরবর্তীতে আরও অনেকেই ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়টির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৩ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শান্তি নিকেতনের প্রতিনিধিবৃন্দ। এছাড়াও দেশের মন্ত্রী, এমপি, সরকারী উর্ধতন কর্মকর্তা, রবীন্দ্র গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিকসহ নানান গুণীজন। কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়টিতে আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে অনেক ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি কেসি মহিদুল আলম নিলু চৌধুরী জানান, দীর্ঘদিনের পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিত্যক্ত মাটির কক্ষগুলো প্রতিবছর সংস্কার করা ব্যয়বহুল ছিল যা বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জোগান দেয়া অসম্ভব ছিল। এই কক্ষগুলো সংস্কারের জন্য সরকারীভাবে কোন অনুদান পাওয়া যায় না। তাই রেজুলেশনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষকের সিদ্ধান্তক্রমে কক্ষগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে এর এক অংশ প্রাচীর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থ আত্মসাতের বিষয় সম্পন্ন ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি। প্রধান শিক্ষক শুকবর আলী জানান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে এই পরিত্যক্ত ঝুঁকিপূর্ণ পুরাকীর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এখানে বিশ্বকবির নামে মিলনায়তন তৈরি করা হবে।
×