ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

আইএসআইয়ের অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

আইএসআইয়ের অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স) বহুদিন ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপতৎপরতায় লিপ্ত। ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাসের ফারিন আরশাদ নামের একজন মহিলা কর্মকর্তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি প্রত্যাহারিত হয়ে দেশে ফেরত গেছেন। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সঙ্গে ফারিনা আরশাদের যোগাযোগের খবর পত্রিকায় এসেছে। এর আগে জাল পাসপোর্ট ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগে গত বছর ১২ জানুয়ারি বনানী থেকে গ্রেফতার হন পাকিস্তান দূতাবাসের কনস্যুলার কর্মকর্তা মোঃ মাজাহার খান। তখন পাকিস্তান দূতাবাসের পক্ষ থেকে মুচলেকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেয়া হয়। গত ৩১ জানুয়ারি মাজাহার খানকে পাকিস্তানে ফেরত যায়। গত ১ ডিসেম্বর পত্রিকায় খবর বের হয় রাজধানীর বিমানবন্দর ও খিলগাঁও থেকে গোয়েন্দা পুলিশ চারজন জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে তিনজন পাকিস্তানী নাগরিক। একজনের নামে ইদ্রিস শেখ এবং আরেকজনের নাম মকবুল শরীফ। তৃতীয়জন পাকিস্তান বেসামরিক বিমান সংস্থা পিআইএয়ের এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টর মোস্তফা জামান। ধারণা করা হচ্ছে ছদ্মবেশে মোস্তফা মূলত আইএসআইয়ের লোক। পাকিস্তানী এই জঙ্গীদের আস্তানা থেকে জঙ্গীবাদ বিষয়ক ২৬টি বই, জাল মুদ্রা, নকল পাসপোর্ট এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। পাকিস্তানী এই জঙ্গীরা পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে তারা বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের সরকার পতনের লক্ষ্য নিয়ে তারা জেএমবিকে পুনরায় সক্রিয় করাসহ ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিল। আটককৃতদের মধ্যে ইদ্রিস শেখ গত দুই বছরের ৪৮ বার পাকিস্তানে যাওয়া-আসা করেছেন। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া পাঁচটি মোবাইল ফোন সেটের মধ্যে ইদ্রিস শেখের মোবাইল স্পাই মোবাইল সেট, যার মাধ্যমে সে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। পাকিস্তান একটি জঙ্গী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্যান ইসলামইজমের মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং বিশ্বব্যাপী জঙ্গী বিস্তারে লিপ্ত। এহেন একটি দেশের নাগরিক ইদ্রিস শেখ দুই বছরে ৪৮ বার পাকিস্তানে গেলেন আসলেন, অথচ ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের কাছে সেটি কখনও অস্বাভাবিক মনে হলো না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ভার আমরা কাদের ওপর দিয়ে রেখেছি তা ভাবলে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে এমনই হবে আর কি। জাল মুদ্রা পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরের অন্তত ২২ পাকিস্তানী নাগরিক গ্রেফতার হয়েছেন। মুদ্রা পাচারের নেটওয়ার্ক থেকে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গী সংগঠনকে অর্থায়ন করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এদের মধ্যে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে গ্রেফতার হওয়া দুই পাকিস্তানী মোঃ দানিশ ও সাব্বির আলী ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে বলেছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান থেকে ভারতীয় জাল মুদ্রার চালান আকাশপথে বাংলাদেশে আনে। পরে তা নেপাল হয়ে ভারতে পাঠায়। এ ধরনের জাল মুদ্রা পাচারকারী একটি চক্র বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির অর্থায়নে জড়িত। ২০০৮ সালের ২৪ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে জেএমবির তৎকালীন শুরা সদস্য রফিকুল ইসলাম ওরফে জোবায়ের ও সদস্য হযরত আলী গ্রেফতার হওয়ার পর বিষয়টি প্রকাশ পায়। রফিক তখন জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, তাদের একটি গ্রুপ ভারতীয় জাল মুদ্রা পাচার করে জেএমবির জন্য তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। গত বছর জানুয়ারি মাসে ধৃত হওয়া আইএসআইয়ের লোক মাজাহার খান ছদ্মবেশে বাংলাদেশে কাজ করেছেন প্রায় পৌনে দুই বছর। ধরা না পড়লে হয়ত আরও সময় থাকতেন। মাজাহার খানের সঙ্গী ও সহযোগী মুজিবুর রহমান নামক একজন বাংলাদেশী নাগরিক পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর আইএসআইয়ের অপতৎপরতার খবর গত জানুয়ারি মাসে নতুন করে প্রকাশ্যে আসে। প্রকাশিত তথ্যে-উপাত্তে বোঝা যায় এই মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন যাবত আইএসআইয়ের কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল। ধরা পড়ার আগে দুই বছরে মুজিবুর ২০ বার পাকিস্তান, ১১ বার ভারত এবং ২২ বার থাইল্যান্ডে ভ্রমণ করেছে। মাজাহার খান ধরা পড়ার পর পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল বাংলাদেশের কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসনের অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং অন্যান্য শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে মাজাহারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কিছু জেলায়ও তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন। পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায় মাজাহার খান ভারতীয় নকল টাকা বাংলাদেশ ও ভারতে ছড়িয়ে দিতেন এবং হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং জেএমবির অর্থের যোগানদাতা হিসেবে কাজ করতেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের জন্য জড়িত জেএমবির সদস্যদের সঙ্গেও মাজাহারের যোগসূত্র ছিল বলে জানা গেছে। তার কাছ থেকে যে কাগজ উদ্ধার করা গেছে সেখানে হিযবুত তাহরীর তিনজন দাগী সদস্যের পাসপোর্ট নম্বর পাওয়া গেছে। তাছাড়া মাজাহারের আগে আরও অনেক পাকিস্তানী নাগরিক ভারতীয় নকল টাকাসহ ধরা পড়েছে। ভয়ানক জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য তিনজন পাকিস্তানী নাগরিক ১০ কোটি বিদেশী টাকাসহ ২০১২ সালে ঢাকায় ধরা পড়ে। সবাই তো আর ধরা পড়ে না, সম্ভব নয়। কথায় বলে দশ দিনে চোরের একদিন গৃহস্থের। তাই বাকি নয়দিনের হিসাব কত বড় হতে পারে সেটি অনুমান করলে তো আতঙ্কে উঠতে হয়। সে জন্যই বলছি মাজাহার খান, ফারিন আরশাদের কাহিনী কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পাকিস্তানী রাষ্ট্র পরিচালিত হয় মোল্লা ও মিলিটারির দ্বারা। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, এমপি, পার্লামেন্ট শো পিচ বৈ অন্য কিছু নয়। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাত্তরের লজ্জাকর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আইএসআইয়ের নেট বিস্তার করেছে বাংলাদেশে। এই সুযোগ তারা পেয়েছে, কারণ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শের বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী, জামায়াত ও কট্টর ইসলামিস্ট দলগুলো এই সুযোগ তাদের দিচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির নেতা-নেত্রীরা পাকিস্তানের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন। পাকিস্তান যখন নির্লজ্জ ও ঔদ্ধত্যভাবে সীমাহীন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে একাত্তরের গণহত্যার কথা অস্বীকার করল, ঠিক তখনই বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মেলালেন। অথচ তিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এ লজ্জা বাংলাদেশের মানুষ কোথায় রাখবে। এখানেই শেষ নয়। বিএনপির আরেক বড় নেতা বলে বসলেন, একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা সকলে নির্বোধ ছিলেন। এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। মাজাহার খানের সঙ্গে ধরা পড়া বাংলাদেশী নাগরিক মুজিবুরকে মাজাহারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মাজাহারের পূর্বসূরি। অর্থাৎ আইএসআইয়ের সঙ্গে মুজিবুর বহুদিন জড়িত। তাতে প্রমাণিত হয় পাকিস্তানের নির্ধারিত বৈদেশিক নীতির আওতায় ধারাবাহিকভাবে এই অপকর্ম করে যাচ্ছে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা। আইএসআইয়ের কর্মকা- সম্পর্কে বাংলাদেশের সচেতন মানুষ মাত্রেই জানেন। তবে মাজাহার খানের হাতেনাতে ধরা পড়া এবং একই কারণে ফারিন আরশাদ প্রত্যাহারিত হওয়ায় প্রকাশ্যে প্রমাণিত হলো বাংলাদেশকে ঘিরে আইএসআইয়ের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সহ্য করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অবস্থান এই উপমহাদেশে যতই শক্তিশালী হবে ততই মোল্লা ও মিলিটারি তত্ত্বের প্যান ইসলামইজমের পাকিস্তান পিছু হটবে। তাতে মোল্লা ও মিলিটারি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের লাভ হবে। তারা একটি গণতান্ত্রিক পাকিস্তান পাবে। উপমহাদেশ থেকে রক্ত খেকো সাতচল্লিশের চেতনা বিদায় হবে। রাষ্ট্র হিসেবে সমৃদ্ধির সড়কে ওঠার সুযোগ পাবে পাকিস্তান। শক্তিশালী হবে আঞ্চলিক সংস্থা সার্ক। কিন্তু পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারি একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এতই অন্ধ যে, আঞ্চলিক কোন শান্তি উদ্যোগকেই তারা সফল হতে দেবে না। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আকস্মিক পাকিস্তান সফর এবং নওয়াজ শরীফের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকের ফলে শান্তিকামী মানুষের ধারণা হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বন্ধ দুয়ার বোধ হয় আবার উন্মোচিত হতে চলেছে। কিন্তু বিধিবাম। ঠিক আগের মতোই নরেন্দ্র মোদির সফরের রেশ না কাটতেই পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন জঈশ-ই-মুহম্মদের জঙ্গীরা ১ জানুয়ারি রাতে ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়েছে ভারতের বিমান ঘাঁটি পাঠানকোটে। সবকিছু আবার ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান। বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সম্পর্ক। দ-িত ব্যক্তিদের পক্ষে, এমনকি বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে পাকিস্তান ২০১৩ সালের নবেম্বর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচবার বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে। সে দেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়েছে। প্রতিবার বাংলাদেশ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। সর্বশেষ ২২ নবেম্বর বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মুজাহিদের ফাঁসির প্রতিবাদে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দেয়। পাল্টা হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে ২৩ নবেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে প্রতিবাদপত্র দেয়া হয়েছে। ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও পাকিস্তান আজ অবধি বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নেয়নি। তারা চায় পাকিস্তানপন্থী একটি বাংলাদেশ, যার একটা নমুনা বাংলাদেশে দেখা গেছে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির শাসনামলে। এতদিন সেই শাসন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশও পাকিস্তানের মতো জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত হতো। তাই আইএসআইয়ের সকল ষড়যন্ত্র এবং অপতৎপরতা বন্ধে বাংলাদেশকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×