ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা ফারাবীর একনিষ্ঠ অনুসারী ;###;পলাতক অপারেশন কমান্ডার ফারুকের খোঁজে ভারতে ও দেশে সাঁড়াশি অভিযান ;###;সে অসমের উলফায় যোগ দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে সিআইডি

সবাই শিবির কর্মী ॥ মুক্তমনা ব্লগার হত্যাকারী

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

সবাই শিবির কর্মী ॥ মুক্তমনা ব্লগার হত্যাকারী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যায় সরাসরি জড়িত ছয়জনই এক সময়ে ছাত্র শিবিরের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে সশরীরে হত্যাকা-ের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন পাঁচজন। অপরজন হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রদান ও হত্যার দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। হত্যায় জড়িতরা বিভিন্ন সময় ব্লগার হত্যার ঘটনায় আলোচনায় থাকা গ্রেফতারকৃত শিবিরের সাবেক কর্মী শফিউর রহমান ফারাবীর একনিষ্ঠ অনুসারী। অপারেশন কমান্ডার হিসেবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন পলাতক ফারুক। তাকে গ্রেফতার করতে ভারত ও বাংলাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনায় থাকা অসমের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্য হিসেবে আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে এই পলাতক আসামি। তদন্তে এবং গ্রেফতারকৃত ৩ জনের মধ্যে একজনের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বিজয় হত্যা সম্পর্কে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে মামলাটির তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত বছরের ১২ মে সকাল সাড়ে আটটার দিকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকার নূরানী পুকুরপাড়ে পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা বিজয়কে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে সিলেটের লাউয়াবাজার শাখায় কর্মরত ছিলেন। বাসা থেকে ব্যাংকে যাওয়ার পথেই তিনি হত্যাকা-ের শিকার হন। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকার সিআইডি। তদন্তের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ২৭ আগস্ট সিলেট থেকে মান্নান ইয়াহিয়া (২৪) ও তার ছোট ভাই মোহাইমিন নোমান (২১) গ্রেফতার হন। সহোদরদের দেয়া তথ্যমতে ওই বছরই ২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন আবুল খায়ের (২২)। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মান্নান ইয়াহিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে বিজয় হত্যার অনেক অজানা তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হত্যার সঙ্গে সরাসরি ৬ জনের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরা সবাই এক সময় ছাত্র শিবিরের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এদের নানাভাবে ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্লগার বিজয় হত্যায় প্ররোচিত করে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র। পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অনন্ত আপত্তিকর লেখালেখি করত। তাকে হত্যা করা বিশাল সওয়াবের কাজ। এভাবেই ওই চক্রটি অনন্তকে হত্যা করতে ছয় জনকে প্ররোচিত করেছিল। পাশাপাশি হত্যার সঙ্গে জড়িত ছয় জনকে মোটা অঙ্কের টাকা এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাল চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়েছিল। তারই সূত্র ধরে দেড় মাস আগে অনন্তকে হত্যার পরিকল্পনা করে ওই ছয়জন। হত্যাকারীরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং একই আদর্শের অনুসারী। তারা বাড়িতে ও ব্যাংকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বাড়ির সামনেই হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। হত্যায় ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল ভাড়া নেয়া হয়। হত্যাকা-ে জড়িত ৬ জনের মধ্যে ৪ জনই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট থানা এলাকায়। ২ জন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার দিন দুটি মোটরসাইকেলযোগে ৫ হত্যাকারী ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে একত্রে রওনা হয়। ৫ জনের মধ্যে ৩ জনের কাছে কালো ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগেই ছিল হত্যাকা-ে ব্যবহৃত চাপাতি। মোটরসাইকেল দুটি ঘটনাস্থল থেকে ১০ থেকে ১২ গজ দূরে রাখা হয়। তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে। অনন্ত পুকুরপাড়ে পৌঁছা মাত্র ৫ জনকে তাকে ঘিরে ফেলে। চাপাতি দিয়ে মাথায় ও ঘাড়ে কুপিয়ে দুই জনে অনন্তকে হত্যা করে। বাকি তিন জন অনন্তকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে মাত্র ৫ থেকে ৬ গজ দূরে অবস্থান করতে থাকে। তারা সেখানে থাকা রাস্তার মুখে অবস্থান নেয়। যাতে কেউ অনন্তকে যেখানে কোপানো হচ্ছে, সেখানে যেতে না পারে। দুজন চারদিকে সতর্ক নজর রাখে। একজন অনন্তকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। মাত্র কয়েক মিনিটেই কুপিয়ে অনন্তর মৃত্যু নিশ্চিত করার পর, তারা চাপাতি ব্যাগে ভরে সেই মোটরসাইকেলযোগেই দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। যে দুজন অনন্তকে কুপিয়ে হত্যা করে, তার মধ্যে আবুল খায়ের অন্যতম। পরে মোবাইল ফোনে তোলা হত্যাকা-ের ভিডিও এবং ছবি একজনের কাছে ইমেল করে পাঠানো হয়। তার মাধ্যমেই হত্যার পর বিজয়ের লাশ পড়ে থাকার দৃশ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ পায়। পাশাপাশি তিনি হত্যার দায় স্বীকার করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে বিবৃতি দেন। জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত তিন জনের মধ্যে মান্নান ইয়াহিয়া ও নোমান ইসলামী ছাত্র মজলিশের সক্রিয় সদস্য। বাড়ি সিলেটের কানাইঘাটের পূর্বপালজুড় গ্রামে। পিতা হাফিজ মইনউদ্দিন। স্থানীয় একটি মসজিদের মোয়াজ্জিন। পাশাপাশি তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। হত্যাকা-ের আগে মান্নান ইয়াহিয়া নাম পরিবর্তন করে মান্নান রাহী এবং হত্যাকা-ের পরে ইবনে মাইউন নামে ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগ থেকে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। তার ভাই মোহাইমিন নোমান সিলেটের এমসি (মুরারী চাঁদ) কলেজের ইসলামিক শিক্ষা বিভাগের ছাত্র। গ্রেফতারকৃত অপরজন আবুল খায়েরের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাটেই। তিনি সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ছাত্র। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, পলাতকদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ফারুক অপারেশন কমান্ডার হিসেবে সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে বিজয় হত্যাকা- ঘটায়। সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে ঘন ঘন যাতায়াতের চেষ্টা করছেন তিনি। ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করায় তাকে গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাকে গ্রেফতার করতে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও জাতীয় তদন্ত সংস্থাসহ (এনআইএ) ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভারতের স্থল সীমান্তে এবং দেশটির অভ্যন্তরে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। তিনি অসমের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনে আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাকে গ্রেফতার করতে তার পুরো পরিবারের ওপর নজরদারি চলছে। তার বড়ভাই সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের কর্মকর্তা। তাকে ইতোমধ্যেই কয়েক দফা সিআইডি সদর দফতরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ফারুক পরিবারের সঙ্গে হত্যাকা-ের পর পর কয়েকদিন যোগাযোগ রেখেছিল। এরপর পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে। সিআইডির এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলছেন, বিজয় হত্যায় সরাসরি জড়িত ৬ জনই লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় কারাগারে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অনিয়মিত ছাত্র এবং ছাত্র শিবিরের সাবেক সক্রিয় কর্মী শফিউর রহমান ফারাবীর একনিষ্ঠ অনুসারী। প্রসঙ্গত, ফারাবী ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যার পর আলোচনায় চলে আসেন। নামাজ আদায়কারী ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন। বর্তমানে ফারাবী গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা লেখক প্রকৌশলী ড. অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী। সিআইডি সূত্র বলছে, ফারাবীর সঙ্গে বিজয় হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়া মান্নান রাহী নিহত অনন্তর লেখালেখির বিষয়ে কি করা যায়, তা নিয়ে ফেসবুকে কথা বলেন। মান্নান ইয়াহিয়া ফেসবুকে ফারাবীর কাছে অনন্তর লেখালেখি বন্ধ করতে কি করা যায়, তা জানতে চান। উত্তরে ফারাবী ফেসবুকে লেখেন : অনন্তকে থাবা বাবার (ব্লগার রাজীব) পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিলেই হয়! ব্লগার রাজীব থাবা বাবা নামের একটি ব্লগে লেখালেখি করতেন। সেই লেখালেখির সূত্র ধরেই রাজীব হত্যাকা-ের শিকার হন। ফারাবীর কথামতো অনন্তকেও রাজীবের মতো নিজ বাসার সামনেই হত্যা করা হয়। মামলাটির তদন্ত সংস্থা সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মির্জা আবদুল্লাহেল বাকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, হত্যাকা-ের তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। পলাতকদের গ্রেফতার করতে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও ভিডিওচিত্রসহ অন্যান্য আলামত উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ধর্মীয় অনুভূতির সূত্র ধরেই একটি চক্র বিজয়কে হত্যা করায়। হত্যাকারীরা উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী।
×