ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অশিক্ষা, কুসংস্কারের অভিশাপ- দুঃসহ জীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫

অশিক্ষা, কুসংস্কারের অভিশাপ- দুঃসহ জীবন

আবু জাফর সাবু ॥ গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের হাজিপাড়া গ্রামে এখনও বন্ধ হয়নি বাল্যবিবাহ। অশিক্ষা, যৌতুক আর কুসংস্কারের অভিশাপে এ গ্রামের সাধারণ মানুষ আজও জর্জরিত। ফলে এখানকার গ্রামগুলোতে বাল্যবিয়ের হার এখনও রয়েছে উল্লেখযোগ্য। অথচ জেলা শহর থেকে এ এলাকার দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসকেএস ফাউন্ডেশন পরিচালিত ইমেজ প্রকল্পের সাম্প্রতিক এক জরিপ থেকে জানা গেছে, ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের হাজিপাড়ায় সম্প্রতি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে ৬৪টি। ওই গ্রামের পোড়াবাড়ির মোড় থেকে নবীরের বাড়ি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার বঞ্চিত দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। এই জরিপ থেকে উঠে এসেছে রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নে বাল্যবিবাহের শিকার বিবাহিত কিশোরীর সংখ্যা ১ হাজার ৪১৪ জন। এর মধ্যে শুধু ৮নং ওয়ার্ডেই রয়েছে ২১০ জন। যারা ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সেই বাল্যবিয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে। বিয়ের প্রথম বছরেই জন্ম দিয়েছে অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু। আর নিজের ও শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে হতাশাপূর্ণ একঘেয়ে নিরানন্দ জীবনের গাঁটছাড়ায় আটকা পড়েছে। জন্ম নিবন্ধন ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সর্বাধিক সক্রিয় ভূমিকা পালনের কথা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের। কিন্তু রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নে তার ব্যতিক্রম। চেয়ারম্যান যে ৮নং ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা, সেখানেই বাল্যবিবাহ সর্বাধিক। কেন এমনটা হচ্ছে? সে ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অশিক্ষা আর যৌতুক অন্যতম কারণ। তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্মসনদ প্রদান করেন না উল্লেখ করে বলেন, ওয়ার্ড মেম্বার, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপারিশে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করলেই জন্মনিবন্ধন সনদ দেয়া হয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে গার্মন্টেসে চাকরির কথা বলে অনেক অভিভাবক মেয়ের বয়স বৃদ্ধি করেও জন্মসনদ নিয়ে থাকেন। ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজী আব্দুল হালিম-যিনি ওই এলাকায় বিয়ে পড়ান এবং রেজিস্ট্রি করেন, তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ চান, কিন্তু জন্মনিবন্ধন থাকলে তিনি বিয়ে পড়াতে বাধ্য হন। তদুপরি অধিকাংশই শহরের কাজির কাছে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করান বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে ওই এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে যে তথ্য জানা গেছে, তাতে পরিলক্ষিত হয় হাজিপাড়াসহ ৮নং ওয়ার্ডের গ্রাম-মহলাগুলোর ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোরীদের কম বয়সী যুবকদের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করার প্রবণতা বেশি। ফলে মান-সম্মানের ভয়ে তাদের পিতা-মাতা অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হন। তদুপরি বেশি বয়সে মেয়ে বিয়ে দেয়ার ঝামেলা, অভিভাবকদের মন মানসিকতা, কম বয়সী মেয়েদের পাত্রী হিসেবে চাহিদা, যৌতুক, জন্মনিবন্ধন প্রাপ্তি ও কাজির দিয়ে বিয়ে অনুষ্ঠানের সুবিধা, প্রয়োজনে অন্য এলাকায় গিয়ে এফিডেভিট করে কাজির কাছে সহজেই বিয়ে পড়ানো এবং রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ। মূলত এগুলোই এখানে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য কারণ। উল্লেখ্য, বাল্যবিবাহের শিকার বিবাহিত কিশোরীদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলার ৩টি ইউনিয়নে ইমেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এ্যান্ড কমিউনিকেশন্স। গাইবান্ধার রামচন্দ্রপুর, কুড়িগ্রামের ঘোগাদহ এবং নীলফামারীর সংগলশি ইউনিয়নের ৪ হাজার ৫শ’ বিবাহিত কিশোরীদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের লক্ষ্য অর্জনে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার আদায়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে এই প্রকল্পের আওতায়। গাইবান্ধার রামচন্দ্রপুরে ১ হাজার ৪১৪ জন বিবাহিত কিশোরীর মর্যাদাপূর্ণ জীবন অর্জনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসকেএস ফাউন্ডেশন কাজ করছে। এছাড়া কুড়িগ্রামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তেরা দেসোম লুসেন আর নীলফামারীর পল্লীশ্রী ২টি ইউনিয়নের বাকি ৩ হাজার ৮৬ জন বিবাহিত কিশোরীর মর্যাদাপূর্ণ জীবন এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার অর্জনে কাজ করছে। বিবাহিত কিশোরীদের ক্ষমতায়নের উদ্যোগ এই ইমেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে দি এ্যাম্বাসি অব দ্য কিংডম অব দি নেদারল্যান্ডস্ ও তের দেসোম নেদার ল্যান্ডস্।
×