ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দায় স্বীকার ॥ প্রাণ ভিক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

দায় স্বীকার ॥ প্রাণ  ভিক্ষা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের দুই কুখ্যাত মানবতাবিরোধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোন সুযোগ নেই। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলেও মৃত্যুদ- কার্যকরে কোন বাধা ছিল না। রবিবার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রাণ বাঁচাতে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে ক্ষমার আবেদন করেছিলেন। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করলেও ‘কৌশল’ বের করার কম চেষ্টা তারা করেনি। যুদ্ধাপরাধী এই দুই সাবেক মন্ত্রীর ক্ষমার আবেদন রাষ্ট্রপতি নাকচ করার পর রবিবার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ নিজেদের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। তাদের দুই জনের আবেদনেই সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। সূত্র জানায়, সাকা চৌধুরী ‘বাংলা খাতার (ছক কাটা)’ কাগজে চার পাতায় নিজ হাতে ইংরেজীতে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। অন্যদিকে মুজাহিদ সাধারণ সাদা কাগজে দুই পৃষ্ঠায় বাংলায় প্রাণভিক্ষার আবেদনটি করেন। আইন মন্ত্রণালয়ের ওই সূত্রটি জানায়, সাকা ও মুজাহিদ সরাসরি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এমন কথা স্বীকার করেননি। অত্যন্ত কৌশলে দু’জনই প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। তবে তারা জড়িত ছিলেন না এমন কথাও বলেননি। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তারা অপরাধ স্বীকার করেছেন। একাধিক সূত্র জানায়, পুরো আবেদনের কোথায়ও তারা নিজেরা অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এ কথা বলেননি। আবার তারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন তা-ও স্পষ্ট করে বলেননি। সূত্রমতে প্রাণভিক্ষার আবেদনে তারা উভয়েই বলেন, তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মকৌশলের কারণে ১৯৭১ সালে অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাই ওই সময়কার ঘটনার দায় তারা এড়াতে পারেন না। কোন আসামি মৃত্যুদ-ে দ-িত হলে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ওই আসামিকে ক্ষমা করার এখতিয়ার রয়েছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’ আইনজ্ঞরা বলেছেন, কোন আসামি ৪৯ অনুচ্ছেদের এই সুযোগ নিতে চাইলে তাকে অবশ্যই দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে হবে। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ॥ সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদ মৃত্যুদণ্ড মওকুফ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলেও তা নিয়ে তাদের পরিবার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। রবিবার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই- উনারা (সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদ) যে দরখাস্ত করেছিলেন, তা সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদটি পড়েও শোনান আইনমন্ত্রী। আইনমন্ত্রী বলেন, যদি কোনো আবেদনের উপরে লেখা থাকে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৯ প্রসঙ্গে, তাহলে কি সেটা মাফ চাওয়ার দরখাস্ত হয় না? সেটা আপনারা (সাংবাদিক) বিচার করেন। এর আগে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল মুজাহিদের দল জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মোঃ কামারুজ্জামানের। তারা দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। আইনমন্ত্রী বলেন, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করা। ক্ষমা না চাইলেও কিন্তু রায় কার্যকর করতে পারতাম। এটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে অবান্তর, একটা ইস্যু সৃষ্টি করা। প্রাণভিক্ষার আবেদন চাওয়া-না চাওয়া নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে ভিন্ন বক্তব্য আসায় ওই আবেদন প্রকাশ করা হবে কি না- এ প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়া ওই দরখাস্ত প্রকাশ করা যাবে না। সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর না করতে কোন বিদেশি সরকারের চাপ ছিল না বলে জানান আইনমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো কমার্শিয়াল সংগঠন যদি রায় স্থগিতের অনুরোধ করে, আমরা তা মানতে রাজি নই। আমরা স্বাধীন দেশ, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করেছি। তিনি আরও বলেন, যখন কেউ পয়সা দেয় এ্যামনেস্টি তখন তাদের গান গায়, একপক্ষের কথা বলে, ফাঁসি স্থগিত চেয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের বক্তব্যের জবাব দেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ॥ ক্ষমার আবেদন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আবেদন তো আমাদের কাছে এসেছে। তাদের জানার কথা নয়। যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের তৎপরতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সাকা চৌধুরীর ছেলে কোন জায়গায় ছোটাছুটি করতে তো কম যায় নাই। বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছে। তার পার্টি চিফের বাসায় গিয়েছে, সব জায়গায় গিয়েছে। শাস্তি মওকুফ করার জন্য কিংবা একটা কৌশল বের করার জন্য সবরকম প্রচেষ্টা তারা করেছেন। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরীর সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগই বাকি ছিল। সেই সুযোগ তারা নিয়েছেন বলে শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে দুই পরিবারই এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে জানায়, বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার আগে তারা বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছেন না। রাতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি ক্ষমার আবেদন নাকচ করেছেন এবং দণ্ড কার্যকরে কোন বাধা নেই। ফাঁসি কার্যকরের আগে রাতে কারাগারে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসে হুম্মাম সাংবাদিকদের বলেন, বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কি মার্সি পিটিশন করেছ? তিনি বলেছেন, ‘এরকম বাজে কথা কে বলেছে?’ রবিবার সকালে সাকা চৌধুরীকে চট্টগ্রামের রাউজানে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করার পর আবারও এ বিষয়ে কথা বলেন হুম্মাম। তিনি বলেন, আমাদের বারবার বলা হয়েছে- সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। যাকে বাংলার মানুষ বাঘ হিসেবে চেনে তিনি মাথানত করতে পারেন না। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমা না চাইলে আমরা যাব কেন? কয়েক ঘণ্টা ধরে এ মন্ত্রণালয়, সে মন্ত্রণালয় গেলাম, না চাইলে যাব কেন? তিনি বলেন, আমরা ধরেই নিয়েছিলাম তারা ক্ষমা চাইবেন না। কিন্তু সকালের দিকে মুজাহিদ সাহেব যে আবেদন দিলেন তার শিরোনামেই ৪৯ অনুচ্ছেদের কথা ছিল। আর সালাউদ্দিন কাদের আবেদন করেছেন ইংরেজীতে। সেখানেও শেষ দিকে আর্টিকেল ফোর্টিনাইনের কথা আছে। আবেদন দুটি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হলে রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন বলে জানান কামাল।
×