ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সহযোগিতার অভাবেই প্রতিভা ধরে রাখতে তারা ব্যর্থ

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ॥ সেথায় এক পড়শী বসত করে

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৩১ অক্টোবর ২০১৫

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ॥ সেথায় এক পড়শী বসত করে

বাড়ির পাশে আড়শিনগর, সেথায় এক পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে...’ লালনের কথার কিংবদন্তির এই সুর সবকালেই মনে করিয়ে দেয় সৃষ্টিশীল সেসব মানুষদের, যাদের কত কাছে থেকেও চিনি না। বাংলার সংস্কৃতি ও লোকজ ধারার উৎপত্তি যে মাটিতে সেখানে আমরা সহসা তাকাতে চাই না। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...। কল্পনায় ছবি এঁকে আবিষ্কার করেছেন নাটোরের বনলতা সেনকে। কবিতার সেই বনলতা সেন আমাদের কাব্যে সাহিত্যে সঙ্গীতে সৃষ্টিশীলতায় সৌন্দর্যের চিরকালিন উপমা হয়ে আছে। আমাদের চারপাশে সংস্কৃতির প্রতিটি শাখা প্রশাখার বিচরণ করছেন এমন গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও তরুণ যারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণের আকুলতায়। সুপ্ত ভাবনাকে বিকশিত করার কোন পথ খুঁজে না পেয়ে কখনও সৃষ্টিশীল মেধাকে বিসর্জন দিচ্ছে। বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এমন সব শিল্পী যারা সামান্য সহযোগিতার অভাবেই নিজেদের প্রতিভাকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। একটা সময় হেমন্তের মধ্যভাগেই গ্রামে নানা ধরনের মেলা শুরু হয়ে পুরো শীত মৌসুমটাকে সংস্কৃতির শিকড়ের বৃত্তে ঢেউয়ের স্রোতধারায় ধরে রেখে প্রতিধ্বনিত করে বসন্তের শেষ ভাগে গিয়ে ঠেকেছে। হৃদয়ের আবেগে মনের ফল্গুধারায় কবিগান পালাগান জারিসারি ভাটিয়ালি গীত কীর্তন পুঁথিপাঠ... নাচ গান যাত্রা নাটক কত কিই না মাঠে মঞ্চে আঙিনায় ক্ষেত খামারে উৎসবের ধারায় উপস্থাপিত। গ্রামে খেয়াঘাটে বটতলায় শিকড়ের ওপর ও বাঁশের মাচাংয়ে বসে গল্পের ছলে গান সুর অভিনয় সবই উঠে এসেছে। বেশিরভাগ গ্রামে খেয়াঘাটের কাছেই ছিল ঢুলিদের ঘর। তার আশপাশেই কোন কিষাণের বাড়িঘরে থাকত একতারা, দোতারা। বাঙালী হৃদয় থেকে উৎসারিত যে ভাবাবেগ সুর ছন্দ ও কথায় আবৃত করে তোলে, লোকজ যে ছন্দ সংস্কৃতির প্রতি পরতে ধরে রেখে এগিয়ে নিয়ে যায় চিরন্তনের পথে তাদের খুঁজে বের করা কি খুবই কঠিন! রেলগাড়িতে যে শিল্পী একতারায় সুর তুলে যাত্রীদের ক্ষণিকের আনন্দ দেয় তাকে কতটা সাধনা করতে হয়েছে তা কি ভেবে দেখি! মাঝি বৈঠা দিয়ে শরীরের শক্তি ক্ষয় করে নদীর ঢেউকে সরিয়ে নৌকা এগিয়ে নেয়ার সঙ্গে কণ্ঠে সুরও তোলে। শক্তি আর সুরের এই সমন্বয় কি এতই সহজ! জীবন নাটকের নাট্যকার যেই হন যিনি নাটকের সংলাপকে জীবনের বাস্তবতায় কথায় সাজিয়ে কণ্ঠের ঢেউ তরঙ্গে কখনও মঞ্চে কখনও পর্দায় তুলে ধরেন সেই প্রতিভাকে কি অস্বীকার করার উপায় আছে! এমন মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মাটির কাছাকাছি। শিশু থেকে কিশোর, তারপর যৌবনে ও তারুণ্যের অধ্যায়ে এগিয়ে চলা এই শিল্পীদের কাউকে আমরা চিনি কাউকে চিনি না, কেউ অচেনাই থেকে যায়। এমন চেনা ও অচেনাদের ভিড়ে এক শিশু মিম। বয়স প্রায় দশ বছর। বগুড়ার মালতিনগরের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। দিনভর চাঞ্চল্যে মাতিয়ে রাখে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মিম। এর মধ্যেই লেখাপড়া। ছোটগল্পের নতুন ধারার রূপকার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক হোসনে আরা মণির ‘শক’ গল্প অবলম্বনে ঢাকার ইনফ্রিকুয়েন্ট ক্রিয়েশন স্বল্প দৈর্ঘের ছবি নির্মাণের জন্য যখন ছোট্ট আদুরে শিশু খুঁজছিল, তখন মিমের সন্ধান দেন বগুড়ার নাট্যকার ও অভিনেতা শামীম। ৬ মিনিটের প্রতীকী ছবিতে শিশুশিল্পী মিমের অভিনয় এতটাই প্রাণবন্ত যা পরিচালক আকতারুল আলম তিনুকেও মুগ্ধ করে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মিমের অভিনয় দর্শক শ্রোতাদের চোখে জল এনে দেয়। মিম স্কুলের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশ নেয়। এই শিশু যে একদিন বড় শিল্পী হবে তার পূর্বাভাস দিয়েছে শক ছবি। তারপরও কথা থাকে- কতদূর এগোতে পারবে সে! বগুড়ার আরেক শিল্পী আমিনুল ইসলাম জাকির। বয়স প্রায় ৪০। লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেননি। কিশোর বেলাতেই নাটকের প্রতি এতটাই অনুরক্ত হন যে, গত ৩০ বছর ধরে মঞ্চই তার আরাধনা। যে কোন চরিত্রেই অনবদ্য। এই শিল্পীকেও দীক্ষা দিয়েছেন নাট্যকার জিল্লুর রহমান শামীম। আর নান্দনিক নাট্যদলের কর্ণধার খলিলুর রহমান তাকে গড়ে তুলেছেন। প্রচারবিমুখ জাকিরের কথাÑ মঞ্চের দর্শকরা তার বিচার করে, এটাই তার বড় পাওনা। এমন কথা ক’জনা বলতে পারে! বগুড়ার ফুলবাড়ী গ্রামের তরুণ রিন্টু সরকার। কিছুটা ডানপিটে স্বভাবের হলেও দুষ্টুমিতেই নাটকে প্রবেশ। মাধ্যমিক পাঠের সময়ই জেদ চাপে নাটকে অভিনয় করা যাবে না কেন! সে তো বাস্তবতার মধ্যেই বেড়ে উঠেছে। সমাজের কত মানুষের কত রূপ দেখেছে। ভাল মানুষ দেখেছে, ভ- মানুষও দেখেছে। এমনই কিছু চরিত্রে গ্রামের কয়েকটি নাটকে অভিনয় করার পর দর্শকদের এতটাই ভালবাসা পায়, নাটকের চরিত্রই তার নাম হয়ে যায়। এখনও সময় সুযোগ পেলে মঞ্চে ওঠেন। এই প্রতিভা কতটা ধরে রাখতে পারবেন তাও প্রশ্ন! জীবনের তাগিদে এক প্রতিষ্ঠানে ডাটা এন্ট্রি ও কম্পিউটারের কাজ করতে হয়। বগুড়ার প্রতিভাবান সঙ্গীত ও নাটকের শিল্পী মনিরা আফরোজ উর্মি। লোকজ সঙ্গীতের ধারায় বেড়ে উঠেছেন। বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। এই প্রতিভাবান শিল্পী নাটক ও সঙ্গীতে সমান্তরাল পথে এগিয়ে চলেছেন। সঙ্গীতে যেমন কণ্ঠের কারুকাজ নিয়ে সুরের স্রোতকে ঢেউ খেলিয়ে বয়ে নিয়ে যায়, নাটকেও অভিনয়ের দক্ষতার ছাপ রাখে। নাট্যকার শামীম জানান, সঙ্গীত ও নাটকে সমান্তরাল এমন প্রতিভা খুব কমই মেলে। প্রতিভাবান শিল্পীদের তালিকায় অনেকেই আছে না ফোটা ফুলের মতো। কলি আর পাপড়ি মেলতে পারে না। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×