ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইএসের অন্যতম লক্ষ্যস্থল দক্ষিণ এশিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৯ আগস্ট ২০১৫

আইএসের অন্যতম লক্ষ্যস্থল দক্ষিণ এশিয়া

নাজনীন আখতার ॥ ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিধ্বংসী বৈশ্বিক আগ্রাসন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে এ আগ্রাসন বিস্তৃতি লাভ করছে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায়। অন্য ইসলামিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে ত্রাস তালেবানের চেয়ে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে উপস্থিত আইএসের অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও নৃশংসতা এমনকি ইসলাম ধর্মের মধ্যে মুক্তমনাদের ওপর আক্রমণ ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা ও কৌশল অনেক বেশি প্রকাশ্য হলেও তা রোধে বিশ্বব্যাপী তৎপরতাগুলো কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে না। উল্টো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে তরুণ-তরুণী সংগ্রহ করে আইএস সংগঠনকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে কব্জা করে ফেলা এই সংগঠনটি পরবর্তীতে কোন্ দেশে শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করবে তা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। ভিন্নমত থাকলেও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আইএসের পাঁচ বছরের পরিকল্পনার মানচিত্রে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। উগ্র চরমপন্থার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ। আইএস জন্ম নেয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক নানান বিশ্লেষণ বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আইএস বিস্তারে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে সেসব অঞ্চলে আইএসের প্রভাব বিস্তার ও দেশগুলোকে সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করা আইএসের জন্য দক্ষিণ এশিয়া ভাল লক্ষ্যস্থল। এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ অঙ্গসংগঠনও। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার মতে, ইজতেমাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে কয়েক শ’ আইএস সদস্য। তাদের মূল লক্ষ্য খেলাফতের নামে বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মভীরু তরুণদের প্রভাবিত করে আইএস সদস্য করা, কেন্দ্রে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং অন্য ধর্মের মুক্তমনা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হিংস্র মানসিকতা তৈরি করা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইএস তালেবানের আরেক রূপ হলেও স্পষ্টতই তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা রয়েছে। তরুণদের কাছে নিজেদের আরও কট্টর প্রমাণ করতে তাই নৃশংসতায় তালেবানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে আইএস। তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে মৃত ঘোষণার পর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তালেবানের মধ্যে নেতৃত্ব সঙ্কট তৈরি হয়েছে। চলছে অন্তর্কলহও। তালেবানের অনেক নেতা ও কর্মী যোগ দিয়েছে আইএসে। দক্ষিণ এশিয়া যে জঙ্গী সংগঠনগুলোর লক্ষ্যস্থল ও আধিপত্য বিস্তারের জায়গা তা আরও স্পষ্ট হয়েছিল আল কায়েদার শীর্ষস্থানীয় বর্ষীয়ান নেতা আয়মন আল-জাওয়াহিরির এক ভিডিও বার্তায়। ৫৫ মিনিটের ওই ভিডিও বার্তায় তিনি ভারতে আল কায়েদার শাখা খোলার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আল কায়েদার ভারতীয় শাখা গঠনের ফলে উপমহাদেশে ইসলামী শাসনের জিহাদী ঝা-া উর্ধে তুলে ধরা সম্ভব হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে আল কায়েদার শাখা গঠন মিয়ানমার, বাংলাদেশ, অসম, গুজরাট, আহমেদাবাদ ও কাশ্মীরের মুসলিমদের জন্য আনন্দের খবর। নতুন এ শাখা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যায় ও অত্যাচার থেকে রক্ষা করবে।’ বিশ্লেষকদের মতে, আইএসের জন্য তরুণ যোদ্ধা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন জাওয়াহিরি। ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট নামে একটি পাক্ষিক আন্তর্জাতিক জার্নালের আগস্ট সংখ্যায় আইএস সম্পর্কে বলা হয়েছে, বৈশ্বিকভাবে আইএসের আগ্রাসনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারকে সংগঠনটি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। বেশকিছু ঘটনা ইঙ্গিত করছে- দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ে উঠতে পারে সংগঠনটির সবচেয়ে সাম্প্রতিক ফ্রন্ট। বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন থেকে আইএসমুখী যোদ্ধা বাড়ছে। বিশেষ করে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর ঘোষণা আসার পর দলটি থেকে নেতাকর্মীরা আইএসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হচ্ছে। কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন পাওয়া গেছে যারা আইএসের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছেÑ পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন পাকিস্তানী তালেবান (টিটিপি), তেহরিক-ই-খিলাফত ও ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান-ভিত্তিক দুটি সংগঠন দ্য হিরোস অব ইসলাম ব্রিগেড ইন খোরাসান ও আল তাওহীদ ব্রিগেড ইন খোরাসান এবং ভারতভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আনসার আল-তাওহীদ। জার্নালে বলা হয়, আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী আইএসের আগ্রাসনের চিত্র স্পষ্ট হয় এক বছর আগে। আইএসের একটি গ্রুপ সংগঠনের পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনার একটি মানচিত্র প্রকাশ করে ওই সময়ে। ওই মানচিত্র অনুযায়ী খেলাফতের আওতায় অনেকগুলো দেশকে আইএসের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হবে। সেক্ষেত্রে অনেক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এমন একটি ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ খোঁজার কথা উল্লেখ করা হয় যে দেশ শুধু আইএসের কালো পতাকাতলে শোভা পাবে না, যা পরিণত হবে একটি কঠিন লক্ষ্যস্থলে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ হতে পারে তেমন একটি দেশ, এই অনুমানও করা হয়েছে জার্নালে। তবে অন্য একটি বিদেশী গণমাধ্যমে আইএসের লক্ষ্যস্থল হিসেবে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার নামও উঠে এসেছে। জার্নালে বাংলাদেশকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গণতান্ত্রিক দেশের বিরল উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলা হয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি, সহিংসতা থাকলেও দেশটি যে কোনভাবেই হোক ইতিবাচক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরপরও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কারণে বাংলাদেশ আইএস বিস্তারের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কয়েকজন ইউরোপিয়ান নাগরিকের অস্ত্রসহ আইএসে যোগদান সে আশঙ্কাকে আরও উস্কে দিচ্ছে। জার্নালে বাংলাদেশ সম্পর্কে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার মন্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ উদার, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের সপ্তম ও মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এই দেশ বিশ্বের অস্থির অঞ্চলের উগ্র চরমপন্থার ক্ষেত্রে একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে। ঢাকায় নিযুক্ত বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, আইএস ও আল কায়েদার রাডারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ অঞ্চলে আঞ্চলিক যোগাযোগ চুক্তি বা কানেকটিভিটির জন্য জঙ্গীবাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে কিনা, সে প্রসঙ্গে নেতিবাচক জবাব দেন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধীরা একটি ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করে নিয়েছে এবং সেটা মেনে চলে। এর মানে এই নয় যে, আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে যেতে হবে। বরং আরও বেশি দেশকে এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। তার মতে, ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিচ্ছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখলে নেয়ার পর আইএস জন্মলাভ করে। আল কায়েদা ও আইএস ইরাক ও সিরিয়ায় চারটি ধাপে আধিপত্য বিস্তার করে। প্রথম ধাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালকে। ওই সময়ে ইরাকে আল কায়েদার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটির নেতৃত্বে ছিলেন আবু মুসাব আল-জারকাওয়ি। আল কায়েদা ইন মেসোপটামিয়া নামের ওই দলটি ইরাকে আমেরিকা ও তাদের যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করে। ২০০৬ সালের জুন মাসে জারকাওয়িকে আমেরিকা হত্যা করার পর প্রথম ধাপের সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় ধাপটি চলে ২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক (আইএসআই) নামে সংগঠনটি কয়েকটি জিহাদী সংগঠনের নেটওয়ার্ক হিসেবে আমেরিকা ও যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। তবে ওই সংগঠনটি আমেরিকার নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর কৌশলের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ে। তৃতীয় ধাপটি চলে ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত। ওই সময় আইএসআইকে শক্তিশালী করা হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় আইএসআইএস। যৌথবাহিনী সেখান থেকে সরিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইএসআই শক্তিশালী হয়ে পড়ে। সিরিয়া যুদ্ধের সময় আইএসআই সিরিয়ায় আল-নুসরা ফ্রন্ট নামে একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করে। আইএসআই এবং এর সিরিয়া শাখার মধ্যে সিদ্ধান্ত তৈরিতে মতভেদ দেখা দেয়ায় আইএসআই এবং আল কায়েদার সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়। আর সেই সময়েই জন্ম নেয় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এ্যান্ড গ্রেটার সিরিয়া (আইএসআইএস)। আইএসের চতুর্থ ও সর্বশেষ ধাপটি শুরু হয় ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে। আইএসআইএস ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর মসুল তাদের দখলে নিয়ে যায়। একই সময়ে আইএসআইএস সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে আল-রাক্কাহকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে একটি সরকার কাঠামো তৈরি করে। সংগঠনের ক্রমবর্ধমান সাফল্যে আইএসআইএস ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে, যার নেতৃত্ব দেন আইএসআইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদী। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাপী তা প্রচার শুরু করে।
×