ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গানকে হাতিয়ার করে স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হয়েছিলাম ॥ শাহীন সামাদ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৪ জুলাই ২০১৫

গানকে হাতিয়ার করে স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হয়েছিলাম ॥ শাহীন সামাদ

দেশ বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী শাহীন সামাদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। দেশে-বিদেশে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের মধ্যে শুদ্ধ সঙ্গীতকে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ছায়ানট বিদ্যায়তনে নজরুলসঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষকতা করছেন। খ্যাতিমান এই শিল্পী সম্প্রতি সঙ্গীতজীবনের ৫০ বছর অতিক্রম করেছেন। গুণী এই শিল্পীর সঙ্গীত জীবনের নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে কথা হয়। গান শেখার শুরুর দিকটা জানতে চাই? শাহীন সামাদ : আমার জন্ম ১৯৫২ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ায়। আমার বাবা শামসুল হুদা এবং মা শামসুন্নাহার রহিমা খাতুন দু’জনেই সংস্কৃতিমনা এবং সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন। শিশুকাল থেকেই সঙ্গীতে আমার আগ্রহ দেখে প্রথম তালিম দিয়েছিলেন বাড়িতে, পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করি। মাত্র ৬ বছর বয়সে নিলফামারী গার্লস স্কুলে পড়ার সময় গান গেয়ে আমি প্রথম হই। সেখান থেকেই আমার গানের পথচলা শুরু। আমি তখন ছায়ানটে ভর্তি হইনি। ১৩ বছর বয়সে গুরু ধরে গান শিখতে শুরু করি। আমার প্রথম সঙ্গীতগুরু ছিলেন ওস্তাদ ফজলুল হক। পরবর্তীতে ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে তালিম নিয়েছি। ১৯৬৬ সালে ১৪ বছর বয়স থেকেই ছায়ানটে ভর্তি হই। ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তন থেকে নজরুল সঙ্গীতে পাঁচ বছরের শিক্ষাক্রম শেষ করে আরও তিন বছর বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করি। সমাপনী পরীক্ষায় আমি নজরুলসঙ্গীতে প্রথম মান পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে রেডিও ও টেলিভিশনে অডিশনের মাধ্যমে পাস করি। সঙ্গীত জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি? শাহীন সামাদ : আমার সঙ্গীত জীবনের অনেক ঘটনাই আছে যা স্মরণ রাখার মতো। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ তো অবশ্যই স্মরণীয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা যখন সোচ্চার, তখন থেকেই দেশের স্বাধীনতার জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করতাম। ছায়ানটে তখন যেসব গান শেখানো হতো, সেগুলো ছিল উদ্দীপনামূলক গণসঙ্গীত, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গান। এসব গানই আমার জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে গানকে হাতিয়ার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সামিল হয়েছিলাম। কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন? শাহীন সামাদ : বাসা থেকে তো অনুমতি দেবেই না। আমার একজন শিক্ষক ছিলেন উনিই আমাকে যুদ্ধে যেতে সহযোগিতা করেন। আমার বাবা ছায়ানটে ভর্তি করে দিয়ে মারা যান। মাকে কষ্ট দিয়েই আমি কলকাতা চলে গিয়েছিলাম। মা তো জানতেন না শেষ পর্যন্ত আমি ফিরে আসব কিনা। অনেকেই পুরো পরিবারসহ গেছে আর আমি মাকে বিপদে ফেলে একাই গিয়েছি। তবে আমি সব সময় আশা করতাম আবারও ফিরে আসব। ফিরে আসব স্বাধীন বাংলাদেশে। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে যুক্ত হলেন কিভাবে? শাহীন সামাদ : আমি তখন ১৮ বছরের তরুণী। আমি ঢাকা ছাড়ি ২০ এপ্রিল। কুমিল্লা হয়ে ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা করি। বাসে, ট্রেনে, গাড়িতে পাকসেনারা সেসময় অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়া এড়াতে বোরখা পরেছিলাম। এরপরে আগরতলা হয়ে কলকাতায় যাই ২৩ এপ্রিল। ওখানে গিয়ে শুনলাম ১৪৪ নাম্বার লেলিন স্মরণীতে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়েছে। সেটা ছিল ওখানকার বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসা। এই সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের সমস্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবী সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। আমরা নয় মাসে পুরো পশ্চিম বঙ্গতেই ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছি। দিল্লীতেও এক মাস গান গেয়েছি। মুক্তির গানেও তো আপনি ছিলেন? শাহীন সামাদ : মুক্তির গানে সংগঠন থেকেই যায় কয়েকজন। শারমীন সুলতানা, স্বপন চৌধুরী, দেবু চৌধুরী, লতা চৌধুরী, নায়লা ওরা সবাই ছিল। মুক্তির গানে দেখা যায় যশোরের একটা নদী। ওইখানে কিন্তু সবাইকে যেতে দেয়া হতো না। সেখানে আমাদের সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন সন্জীদা আপা, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান। উনি লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। মুক্তির গানের শূটিং অনেক কষ্টের ছিল। একটা ভাঙ্গা ট্রাকে করে ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। সে সময় লিয়ার লেভিন নামে মার্কিন টিভি সাংবাদিক তাদের সঙ্গে ট্রাকে ওঠেন। লিয়ার লেভিন প্রায় ছয় সপ্তাহ পশ্চিম বাংলায় থেকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধফ্রন্টের ছবি তোলেন। পরে ২২ ঘণ্টার ফুটেজ নিয়ে তিনি ’জয় বাংলা’ নামে ৭২ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু কোন স্পন্সর না পাওয়ায় ছবিটি পরিত্যক্ত হয়। দুই দশকের বেশি সময়ের পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ লিয়ার লেভিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর তোলা ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেন। তাঁরা লিয়ার লেভিনের ফুটেজকে নবরূপান দেন ’মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গাওয়ার সুযোগ হলো কিভাবে? শাহীন সামাদ : সব জায়গাতে গান গাইছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে গান গাওয়ার ডাক আসছে। মোটামুটি নাম ডাক হয়ে গেল যখন, তখনই সমর দা (সমর দাস) ডাকলেন। বালিগঞ্জে আমরা গেলাম। একসঙ্গে আমরা আটটি গান রেকর্ড করে দিয়ে এসেছিলাম। এর পরের বার যখন গিয়েছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পাশে আমাদের জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে আমরা জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলাম। এর পরে আবার আমাদের ডাকলেন, কিন্তু আমরা যেতে পারিনি। তখন আমরা প্রায় ১৪টা গান করি। টালিগঞ্জ স্টুডিও থেকে রেকর্ড করে দিই। সেই গানগুলো প্রায় ছয় মাস বেজেছে। আপনার স্মরণীয় কিছু গানের কথা জানতে চাই? শাহীন সামাদ : ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘চলো যাই চলো যাই’, ‘দেশে দেশে’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘শিকল পরার ছল’, ‘জাগো জাগো প্রতিবাদী হও’, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’, ‘এসো মুক্তি রণের সাথী’, ‘পাক পশুদের মারতে হবে’, ‘শোনেন শোনেন ভাই সবে’সহ আরও কিছু গান। আপনার এ্যালবাম সম্পর্কে কিছু বলুন শাহীন সামাদ : প্রথম আমার ‘মোহাব্বতমে ইয়ে কেয়া’ নামে উর্দু গজলের সিডি প্রকাশ হয়। পরে ‘অভিসার’ ‘নিশিরাত’, ‘লোকান্তরের গান’, ‘নহে নহে প্রিয়’ এবং ‘সন্ধ্যা তারা’ নামে এ্যালবাম প্রকাশ হয়। এছাড়া সম্প্রতি রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, প্রাচীন লোকসঙ্গীত, দেশের গান, আধুনিক গান, ডিএল রায়, রজনীকান্ত সেনসহ বিভিন্ন ধারার গান নিয়ে দুটি এ্যালবামের কাজ চলছে। গানগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করছেন অনুপ বড়ুয়া। আগামী বছর এ্যালবাম দুটি প্রকাশ করবে লেজার ভিশন। সঙ্গীত জীবনে প্রাপ্তি কতটুকু? শাহীন সামাদ : প্রাপ্তি মানুষের ভালবাসা। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে। এছাড়া আমার সঙ্গীত জীবনে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছি। এর মধ্যে নজরুলসঙ্গীতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০০৯ সালে সরকারীভাবে আজীবন সম্মাননা এবং ২০১৪ সালে ময়মনসিংহ নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননা উল্লেখযোগ্য। -গৌতম পাণ্ডে
×