ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খ্যাতি এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৮ জুলাই ২০১৫

খ্যাতি এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের কদর এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। রমজান মাসের শুরুতেই ঈদের আগাম আমেজে সেমাইয়ের চাহিদা যায় বেড়ে। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গেই বগুড়া পরিণত হয় সেমাইয়ের শহরে। এবার রমজানের শুরুতেই বগুড়া সেমাইয়ের মহানগরীতে পরিণত হয়েছে। শহরতলী ও উপজেলা সদরের বিভিন্ন গ্রামে সেমাইয়ের কারিগরদের এখন একদ- ফুরসত নেই। দিনে রাতে সমানে কাজ। দিনের আলোয় সেমাই না শুকানো গেলে বিশেষ ব্যবস্থায় হিট দিয়ে শুকানো হচ্ছে। সেমাই তৈরির বেশিরভাগ কারিগর নারী। দেশের প্রতিটি জেলা থেকে পাইকাররা আসছে সেমাই কেনার জন্য। রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও খুলনার ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত ট্রাকে করে সেমাই নিয়ে যাচ্ছে। এই সেমাই তৈরির ভারি শিল্প তৈরি হয়নি। বগুড়ার অনেক গ্রামে চিকন সেমাই কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। কুটির শিল্পের মাধ্যমেই এই সেমাই দেশে ও বিদেশে চাহিদা মিটাচ্ছে। বগুড়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বললেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সেমাই রফতানির তালিকা এখনও নেই। দুই দেশের মধ্যে রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে বগুড়ার চিকন সেমাই ও দই অন্তর্ভুক্ত করলে উভয় দেশই লাভবান হবে। তবে বিকল্প উপায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সেমাই যাচ্ছে। বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। আশির দশকের শুরুতেও রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতরের দু’দিন আগে শহরের রেলগেটের দুই ধারে গ্রামের কিছু লোক বাঁশের ঝুরির ভাড়ে করে সেমাই এনে পসরা সাজিয়ে বসত। সাধারণত মধ্যবিত্ত, স্বল্প আয়ের রোজগেরে মানুষ এই সেমাই কিনত। ধনী, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বনেদী পরিবার এই সেমাইয়ের ধারে কাছে যেত না। বলা হতো এগুলো গরিবের সেমাই। রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতর অনেক এলাকায় আজও সেমাইয়ের ঈদ নামে পরিচিত। এই ঈদের আনন্দের প্রধান খাবার সেমাই। ধনী গরিব নির্বিশেষে এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে এই ঈদে সেমাই রান্না হয় না। টেবিলে কোর্মা পোলাও বিরিয়ানি খিচুরি যতই থাক সেমাই ছাড়া এই ঈদ হয় না। গত শতকের ৮০’র দশকের মধ্যভাগে এই চিকন সেমাই পথের ধার থেকে শহরের বাজারে দুই একটি দোকানে উঠতে শুরু করে। ৯০’এর দশকের প্রথম ভাগেই হাতে বানানো এই সেমাইয়ের ম্যানুয়াল যন্ত্র আবিষ্কার করে বগুড়ার এক তরুণ। তারপর শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে এই যন্ত্র স্থাপিত হয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেমাই বানানো শুরু হয়। পুরনো কারিগররা প্রশিক্ষণ দিতে থাকে নতুনদের। দ্রুত উৎপাদনের লক্ষ্যে যন্ত্রের আবিষ্কারক নানা শক্তির মোটর সংযুক্ত করে। এরপর আর থেমে থাকে নি। প্রতিবছর চিকন সেমাই উৎপাদনের হার বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে এই চিকন সেমাই মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের ঘর থেকে সরাসরি চলে যায় উচ্চবিত্তের ঘরে। অবস্থা এমন পর্যায়ে ঠেকে চিকন সেমাই দেশজুড়ে আপন গতিতেই স্র্রোতধারায় গিয়ে মেশে ঘরে ঘরে। তারপর আর পিছন ফিরে তাকতে হয়নি। এখন রমজান মাস শুধু নয়, ভর বছর চিকন সেমাই মেলে শহরের বিপণি কেন্দ্রে। যে চিকন সেমাই একদা পথের ধারে বিক্রি হতো সেই চিকন সেমাই বর্তমানে শপিংমল ডিপার্টমেন্ট স্টোরে উঠেছে। এই সেমাইয়ের এতটাই মর্যাদা যে প্রতিটি ঘরে ঈদে ম্যান্ডেটরি তো হয়েছেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় স্বজনদের পাঠাতে হয়। তারা আগাম জানান দেয় চিকন সেমাইয়ের। রমজান মাসে প্রতিদিন ঢাকাগামী কোচের যাত্রীরা দইয়ের সঙ্গে চিকন সেমাই নিয়েই ওঠে। কোন কোন কুরিয়ার সার্ভিস চেকন সেমাই পার্সেল হিসাবে নিচ্ছে। তবে সতর্কতা সংকেত দিয়ে দেয় কোন কারণে গুঁড়ো হয়ে গেলে দায়ী থাকবে না। এই সেমাই এখন খুচরা বিক্রির পাশাপাশি বাহারি প্যাকেটজাত হয়েছে। রান্নার সুবিধার জন্য সেমাই ভাজিয়ে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। তবে তার দাম কিছুটা বেশি পড়ে। বর্তমানে নানা ধরনের চিকন সেমাই মিলছে বাজারে। দাম মান অনুযায়ী প্রতি কেজি ৪৮ টাকা থেকে উর্ধে ৮০ টাকা পর্যন্ত। চিকন ভাজা সেমাই এক শ’টাকা থেকে ১শ’ ২০ টাকা। দাম বেশি কেন এমন প্রশ্নে দোকানি হেসে বলে, রান্নার খাটুনিতো অনেকটা কমে গেছে। রেডি নুডলসের মতো কড়াইয়ে ছেড়ে দিলেই রেড সেমাই তৈরি হয়ে যাবে।
×