মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সরকারী আমদানির সোয়া ৪শ’ কোটি টাকার দুই লাখ টন গম। সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠান এ গমের চালান এনেছে চার জাহাজযোগে ব্রাজিল থেকে। এর ষাট শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরে এবং চল্লিশ শতাংশ মংলা বন্দরে খালাস হয়েছে। খালাসের আগে নিয়মানুযায়ী যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। খাওয়ার উপযুক্ত হিসেবে রিপোর্ট হওয়ায় এসব গম পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন সংস্থায় রেশন হিসেবে বিতরণের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামে প্রেরণ করা হয়েছে। সরবরাহকারী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দেখা গেল এ গম অত্যন্ত নিম্নমানের, ক্ষেত্র বিশেষে পচাও। অতএব, ঘোরতর আপত্তি উঠল সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। তাও সোজা একেবারে প্রধানমন্ত্রী সমীপে। অভিযোগ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হলেন। দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসককে নমুনা সংগ্রহ করে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশও দিলেন। গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তদন্তও করানো হলো। ইতোমধ্যে রিপোর্টও পেশ হয়েছে। রিপোর্ট হয়েছে নেতিবাচক। অর্থাৎ চালানের অধিকাংশ গম নি¤œমানের। এর কিছু অংশ আবার পচাও। অতএব, সরকারী আমদানির গম নিয়ে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। মোটা অঙ্কের কমিশন হাতিয়ে নিতে খাদ্য বিভাগের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পরস্পরের যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, খাদ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে এখনও তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি। তবে আমদানি কার্যক্রম সম্পাদনকালীন সময়ের খাদ্য অধিদফতরের ডিজিকে তাৎক্ষণিক ওএসডি করা হয়েছে। কিন্তু পুরো ঘটনা এখনও রহস্যাবৃতই থেকে গেছে।
এ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ গম পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে রেশন হিসেবে দেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে এ গম টিআর ও কাবিখা কর্মসূচীতে যোগান দেয়া হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে আমদানির এ গম যদি নি¤œমানের হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে খাওয়ার অনুপযোগী হয় তাহলে সাধারণ মানুষকে শ্রমের বিনিময়ে তা দেয়ার বিষয়টি বড় ধরনের প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাদ্য বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র মঙ্গলবার জানায়, গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে গমের এ চালান চারটি জাহাজযোগে আমদানি হয়ে আসে। প্রায় সোয়া ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে টেন্ডারের মাধ্যমে এ গম কেনা হয়েছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দুটি। প্রতিটি জাহাজে ৫০ হাজার টন করে বাংলাদেশে আসার পর নিয়মানুযায়ী এর ৬০ ভাগ চট্টগ্রাম বন্দরে এবং ৪০ ভাগ মংলা বন্দরে খালাস করে তা গৃহীত কর্মসূচী অনুযায়ী বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামে পৌঁছানো হয়েছে। এ জন্য খরচ হয়েছে আরও মোটা অঙ্কের বাড়তি অর্থ। সরবরাহকৃত এ গম ভাঙ্গিয়ে আটা করার পর খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে এক ধরনের দুর্গন্ধ এবং অতৃপ্তির স্বাদ পাওয়া যায়। বিষয়টি আস্তে আস্তে চাউর হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রচার মাধ্যমে চলে আসে এ খবরটি। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীসহ পুলিশ ও অন্যান্য রেশনভোগী সংস্থার পক্ষ থেকে জোরালো অভিযোগ ওঠে। ফলে নড়েচড়ে বসে খাদ্য অধিদফতর। কিন্তু ততক্ষণে তা প্রধানমন্ত্রীর নজরে চলে যায়। ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে পেশকৃত রিপোর্টে গম নিয়ে কেলেঙ্কারির ঘটনার নেপথ্যের নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কাদের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে এবং কারা কারা এর নেপথ্যে জড়িত থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন গ্রহণ করেছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন বাকি রয়েছে শুধু ব্যবস্থা গ্রহণ।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর মঙ্গলবার পর্যন্ত ৪০ জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে গমের নমুনা পৌঁছানো হয়েছে খাদ্য অধিদফতরে। প্রতিটি নমুনা গুণগত মান পরীক্ষা শেষে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রদানের কথা রয়েছে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু নি¤œমানের ও পচা জাতীয় এ গম মানুষের পেটে যাওয়ার আগে তা নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয় বলে খোদ খাদ্য বিভাগ সূত্রে মত ব্যক্ত করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার প্রায়শ ইউক্রেন থেকে গমের চালান আমদানি করে থাকে। এছাড়া অন্য আরও কয়েকটি দেশ থেকেও গম আনা হয়। দেশে বছরে গমের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন। এরমধ্যে দেশে উৎপন্ন হয় সর্বোচ্চ ১০ লাখ টন। অবশিষ্ট গম আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। এর মধ্যে সরকারী পর্যায়ে আমদানি করা হয় সর্বোচ্চ ৬ লাখ টন। বাকি গম বেসরকারী পর্যায়ে আমদানি করা হয়। খাদ্য বিভাগীয় সূত্রে জানানো হয়েছে, এবার ইউক্রেন থেকে গম সরবরাহ দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় ব্রাজিল থেকে তড়িঘড়ি করে এ ২ লাখ টন গমের চালান নিয়ে আসা হয়েছে সরবরাহকারীদের মাধ্যমে। অভিযোগ উঠেছে, এ গম সাধারণ গমের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির এবং কালচে রঙের। এর স্বাদও সাধারণ গমের তুলনায় নি¤œ। এর উপর দীর্ঘদিন ধরে ব্রাজিলে এ গম গুদামজাত হয়ে থাকায় এর গুণগত মান হারিয়েছে। এরপরও সরবরাহকারীরা কিভাবে এ গম বাংলাদেশে আমদানি করে এনেছে এবং তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গ্রহণ করা হয়েছে তা নিয়ে বড় ধরনের জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। অতীতেও চাল, গম নিয়ে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান সরকারের আমলে গম নিয়ে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির এটাই প্রথম ঘটনা।
সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত। তিনি ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে যারা জড়িত থেকে রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতি করেছে পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তিকে বিতর্কের মুখে ঠেলে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। কিন্তু এর সবই হবে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে। খাদ্য বিভাগীয় বিভিন্ন সূত্রে মঙ্গলবার জানানো হয়, এ গমের চালান নিয়ে শুরু থেকে নানা আপত্তি অভিযোগ উঠলেও খাদ্য অধিদফতর তা গ্রহণ করার জন্য এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে রাখে। ফলে তা নির্বিঘেœ খালাস হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে, খাদ্য বিভাগীয় নিজস্ব ল্যাব টেস্টে এ গমের গুণগত মানের রিপোর্ট করা হয়েছে চাপের মুখে। চট্টগ্রামে খাদ্য বিভাগীয় ল্যাব টেস্টের সঙ্গে যারা জড়িত তারা ছিলেন অসহায়। অনুরূপভাবে খুলনায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে গমের এ চালান সহজে গুদাম পর্যন্ত পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছে।
এখন এ গম নিয়ে যখন হৈ চৈ শুরু হয়েছে তখন খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে কোন কথা বলতে নারাজ। রীতিমতো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। খাদ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকারান্তরে তিনি গমের এ চালান নি¤œমানের বলে স্বীকার করে নিলেও খাওয়ার অনুপযোগী বলতে নারাজ। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকারী প্রায় সোয়া চার শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে আমদানি করা গমের এ চালান শেষ পর্যন্ত মানুষের পেটে যাবে, না ধ্বংস করা হবে তা এখনও অনিশ্চিত। প্রতিটি জেলার খাদ্য গুদামে যেসব গম পৌঁছেছে সর্বত্রই একই অভিযোগ। এ গম খাওয়ার অযোগ্য, নি¤œমানের। কিছু গম পচে গেছে। কিছু গম পোকায় ধরেছে। এছাড়া গমের আকৃতি ও রং সাধারণ গমের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। এখন দেখার বিষয় এ গম নিয়ে কেলেঙ্কারির নেপথ্য নায়কদের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে গম নিয়ে কেলেঙ্কারির ঘটনায় অনুসন্ধানের আবেদন জানানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই শুরু হবে পরবর্তী প্রক্রিয়া।