ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন পরিবারের সদস্যরা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৪ এপ্রিল ২০১৫

এখনও স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন পরিবারের সদস্যরা

রহিম শেখ ॥ দুই বছর পরেও সন্তানের খোঁজে মা এসেছেন। এসেছেন স্বামীর খোঁজে স্ত্রী। সন্তান এসেছেন বাবার খোঁজে। রানা প্লাজা ধসের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের এখনও খুঁজে বেড়ান পরিবারের সদস্যরা। রাজধানীর অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ধসের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের এইদিনে ভবন ধসে পাঁচটি পোশাক কারখানার এক হাজার ১৩৭ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হন। ঘটনায় আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। এদের অনেকেই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন বহু শ্রমিক। গত দুই বছরেও ১০৩ জন পোশাক শ্রমিকের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নিহত ও আহত শ্রমিকদের ভাগ্যে কম-বেশি অর্থ জুটলেও পরিচয় সঙ্কটের কারণে অনেক পরিবারের কাছেই ক্ষতিপূরণের অর্থ পৌঁছায়নি। এখন পর্যন্ত যেটুকু অর্থ মিলেছে তাও যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে শ্রমিক সংগঠনগুলো । স্মরণ কালের আলোচিত এই প্রাণহানির ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হলেও এতদিনেও অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল এইদিনে সাভারের নয়তলা ভবন রানা প্লাজায় কি ঘটেছিল তা শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ববাসী জেনেছিল। সকাল ৮টা। পাঁচটি কারখানার শ্রমিকরা দল বেঁধে প্রবেশ করছেন। যে যাঁর মতো করে কাজে যোগ দিচ্ছেন। তখনও তাঁরা জানতেন না কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য। সকাল সাড়ে ৮টায় একযোগে চালু করা হয় ডজনখানেক জেনারেটর। কেঁপে ওঠে নয়তলা ভবনটি। যেন নেমে এসেছিল রোজ কেয়ামত। হাজারখানেক শ্রমিক প্রাণ হারায় ঘটনাস্থলেই। দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এত শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগে ২৩ এপ্রিল বিকেলেই ওই ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। প্রাণের ভয়ে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে চাননি। কিন্তু ভবন মালিক সোহেল রানা জোর করে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। ফাটলের কারণে ভবনে ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও খোলা ছিল পোশাক কারখানা। ভয়াবহ ওই ভবন ধসের ঘটনায় প্রাণে দাগ কেটে যায় গোটা বিশ্ববাসীর। উন্মোচিত হয়ে যায় কতটা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে এদেশের পোশাক শ্রমিকরা। লাভের পেছনে ছুটতে গিয়ে পোশাক শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের কীভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় এ বিষয়টিও উঠে আসে বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোতে। সরকারী হিসাব বলছে, শেষ পর্যন্ত ভবনে আটকেপড়া ও হাসপাতালে মারা যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা গিয়ে দাঁঁড়ায় ১ হাজার ১৩৭ জনে। সূত্র মতে, ওই ঘটনার পর ৮৪৬ মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জুরাইন কবরস্থানে অশনাক্ত হিসেবে দাফন করা হয় ২১৯ জন শ্রমিকের মৃতদেহ। ওই ঘটনায় আহত অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জন শ্রমিককে। এর মধ্যে ৩৬৩ জন শ্রমিক মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে পঙ্গু হয়েছেন। ২৯৯ জন শ্রমিকের হাত ভেঙ্গে পঙ্গু হয়েছেন। ২০৫ জন শ্রমিকের বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গেছে। ১৪০ শ্রমিকের মেরুদ- ভেঙ্গে গেছে। ২৮৮ জন শ্রমিক ওই ঘটনায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঘটনার পর ১৮ জন শ্রমিক হাসপাতালে ও নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এখনও শনাক্ত হয়নি ১০৩ শ্রমিকের পরিচয় ॥ স্মরণকালের ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার শত শত শ্রমিকের মধ্যে ১০৩ পোশাক শ্রমিকের পরিচয় দুই বছরেও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখনও এসব শ্রমিকের স্বজনরা তাদের পরিচয় শনাক্ত করার দাবি করে আসছেন। কিন্তু বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা এই ১০৩ কবরের ডিএনএ নমুনার কোড ঝড়-বৃষ্টিতে মিলিয়ে গেছে। জুরাইন কবরস্থানে কবরগুলোতে এখন শনাক্ত করার কোন নম্বর নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি (এনএফডিপিএল) সূত্র জানায়, নিহতদের মধ্যে পরিচয়হীন ৩২২ লাশের ৩২২টি নমুনা হিসেবে হাড় ও দাঁত দেয়া হয় ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। আর অজ্ঞাত এসব লাশের মা, বাবা, ভাই, বোন, ছেলে-মেয়ে হিসেবে স্বজন দাবিদার ৫৬০ জন তাদের রক্ত নমুনা দেয় ল্যাবরেটরিতে। লাশের ডিএনএ রূপরেখা (প্রোফাইল) তৈরি শেষে এ পর্যন্ত ২০৮ লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়। তবে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৩২২টি লাশ হিসেবে নমুনা দেয়া হলেও এর মধ্যে ১১ জনের নমুনা দুইবার করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ১১ জনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ২২ জনের লাশ হিসেবে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টি ডিএনএ পরীক্ষায় ধরা পড়ে। এ হিসেবে লাশের প্রকৃত সংখ্যা হবে ৩১১। এ হিসেবে এখনও ১০৩ লাশের পরিচয় জানা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন ॥ রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে শ্রম মন্ত্রণালয়, রাজউক, শিল্প, স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজিএমইএ’র একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে দুর্ঘটনার জন্য নয়টি কারণকে দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিজিএমইএ। ভবন তৈরিতে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, ছয়তলার অনুমোদন নিয়ে নয়তলা ভবন নির্মাণ, কলকারখানা পরিদর্শন বিভাগের অসচেতনতা, সাভার পৌরসভার সংশ্লিষ্ট বিভাগের অবহেলা ইত্যাদি কারণে ভবনটি ধসে পড়ে। তাছাড়া একসঙ্গে সব জেনারেটর চালু করা এবং ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি জনবল থাকাকে দুর্ঘটনার বড় কারণ বলে চিহ্নিত করেছে বিজিএমইএ’র তদন্ত কমিটি। দুর্ঘটনায় মামলা ॥ দেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ দুর্ঘটনায় মোট দুটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু এতদিনেও মামলা দুটির অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ১৫ এপ্রিল অবহেলার কারণে মৃত্যু ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলা দুটির অভিযোগপত্র দাখিলের নির্ধারিত দিন ছিল। কিন্তু সিআইডি নির্ধারিত সময়ে ওই অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালত ২১ মে ফের দাখিলের দিন ধার্য করেছেন। এদিকে, হাইকোর্ট দুই মামলার সর্বশেষ অবস্থা প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিল করতে বলেছেন। আগামী রবিবার এ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাভার থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ দুই মামলায় ৫৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল আহম্মেদের বাদী হয়ে ইমারত আইনে দায়ের করা মামলায় ১৭ জনকে আসামি করা হচ্ছে। এই ১৭ জনের মধ্যে সরকারের চারটি প্রতিষ্ঠানের ১৩জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এই ১৩ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করার অনুমতি চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতর-প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে সিআইডি। দুই বছরেও কর্ম জোটেনি শ্রমিকদের ভাগ্যে ॥ রানা প্লাজা ধসের পর যারা আহত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিলেন তাদের অনেকেই এখনও সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন। আর যারা চিকিৎসা শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন তাদের অনেকেরই ভাগ্যে চাকরি জুটেনি। তাদেরই একজন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি রানা প্লাজায় নিউ ওয়েব স্টাইল কারখানায় কাজ করতেন। সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় হাজারও শ্রমিকের সঙ্গে তার স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে এখন অনেকটাই সুস্থ জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জানান, মডার্ন প্লাজা ও আল মুসলিম গ্রুপের কারখানায় চাকরি হয়নি শারীরিকভাবে ‘ফিট’ না হওয়ায়। এরপর আজিম গ্রুপের জিকে কারখানায় কাজ নেন। সেখানে একদিন হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে তিনি ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে নিচে চলে আসেন। এতে সেখানেও তার চাকরিটা চলে যায়। একই ধরনের সমস্যায় পড়েন রানা প্লাজার ফ্যান্টম এ্যাপারেল কারখানার আয়রনম্যান এমদাদুল ইসলাম ও নিউওয়েভ স্টাইলের কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর নাসির উদ্দিন সোহেল। আহতদের সহায়তা ও বিদেশী তহবিল ॥ রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় আহত ও নিহত পরিবারের সদস্যদের মাঝে অর্থ সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে গরমিল দেখা গেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর নিহতদের পরিবার এবং আহতদের এ পর্যন্ত প্রায় ১৮৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিপূরণ বাবদ ক্রেতাদের অর্থে গঠিত রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে দেয়া হয়েছে ৭৬ কোটি টাকা। রানা প্লাজার একটি গার্মেন্ট কারখানার দায়িত্ব নিয়ে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রাইমার্ক দিয়েছে ৮৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা।
×