ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একবারের জন্য হলেও আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে চান

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪

একবারের  জন্য হলেও আবার সোহরাওয়ার্দী  উদ্যানে যেতে চান

শংকর লাল দাশ ভেলোর, ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী এমন অনেক বন্ধু অস্ত্র হাতে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, যাঁদের অনেককেই আমরা চিনি না। তাদেরই একজন স্বামীনাথান গুন্ডার। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো ৬ মাস যুদ্ধ করেছেন খুলনা-সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরে। যদিও তিনি তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাদ্রাজ রেজিমেন্টের একজন নায়েক। তারপরও উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে যুদ্ধকালীন সময়ের বেশিরভাগ কাটিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন সশস্ত্র যুদ্ধে। কৃতিত্বের সঙ্গে হত্যা করেছেন তিনশ’ পাক সেনাকে। নিজেও আহত হয়েছেন। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ তার সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে দিয়েছে ৯টি পদক। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ সৈনিক এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দিন কাটে একটি আবাসিক হোটেলের (লজ) সিকিউরিটি কাম পিয়নের কাজ করে। তবে শেষ জীবনে এখনও স্বপ্ন দেখেন, একবারের জন্য হলেও সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে চান। সেখানকার মাটি কপালে ঠেকাতে চান। যেখানে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো কেটেছে। স্বামীনাথানের বাড়ি ভারতের তামিলনাড়– প্রদেশের ভেলোর জেলা সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বের মুনজুরপেট গ্রামে। ১৯৬০ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাদ্রাজ রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে পাঞ্জাব সীমান্তে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ওই যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষ তাকে নায়েক হিসেবে প্রমোশন দেয়। এর ৬ বছরের মাথায় আসে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বামীনাথান জানান, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শুরু থেকেই তিনি এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে কিছুদিন চাকুলিয়া ক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে আসা যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পরে আগস্ট মাস থেকে যুদ্ধের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। ক্যাপ্টেন রাম সিংহের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অনেক সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তিনি আরও জানান, মূলত তাদের অর্থাৎ ভারতীয় সেনাদের দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে তাদের প্রশিক্ষণ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে, এজন্য পেছন থেকে যত রকমের সহায়তা-সহযোগিতা দরকার তাই করতেন। যুদ্ধের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের কভারিং করতেন। কেউ আহত হলে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতেন। কখনও কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাকে তাদের সঙ্গে মিশে যেতেন। তবে মূল যুদ্ধ অর্থাৎ পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করেছেন ৩ ডিসেম্বর থেকে। ওইদিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। স্বামীনাথান আদৌ বাংলা বা ইংরেজী জানেন না। হিন্দি জানেনÑ তাও অল্পস্বল্প। তামিল ভাষাতেই তিনি কথা বলেন। চট্টগ্রামের আবাসন ব্যবসায়ী মোরশেদ আলমের সহায়তায় নেয়া সাক্ষাতকারে স্বামীনাথান জানান, সাতক্ষীরা-খুলনা থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত অনেক যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছেন। মেজর জলিলের সঙ্গে কিছুদিন ছিলেন। গিয়েছিলেন সুন্দরবনে। বয়সের কারণে এখন অনেক স্মৃতি মনে নেই। অনেক স্মরণীয় ঘটনাও হারিয়ে গেছে জীবনের ইতিহাস থেকে। এরপরেও যা মনে আছে, তাই বলেছেন অকপটে। তিনি জানান, নিজের হাতে অন্তত আড়াই-তিনশ’ খানসেনাকে হত্যা করেছেন। ঢাকার কাছাকাছি এক যুদ্ধে তিনি মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। হাঁটুর ওপরে গুলি লেগেছিল। সেই দাগ দেখিয়ে বলেন, এরপরও তিনি যুদ্ধের মাঠ ছাড়েননি। তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কী? জানতে চাইলে স্বামীনাথান জানান, ‘১৬ ডিসেম্বর বিকেলে যখন পাকিস্তানী সেনারা লাইন বেঁধে অস্ত্র জমা দিচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল বিশ্বজয় করছি। ওই স্মৃতি আজও ভুলিনি।’ তিনি নিজেও বহু পাকিস্তানী সৈনিককে ধরে বেঁধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) নিয়ে এসেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের দেয়া ৯টি পদক ও কিছু সার্টিফিকেট দেখিয়ে স্বামীনাথান জানান, ঢাকার কাছাকাছি এক যুদ্ধে তাঁর ক্যাপ্টেন রামসিংহ শহীদ হন। সে করুণ স্মৃতি তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এ পদক ও সার্টিফিকেট রামসিংহের কারণেই তিনি অর্জন করতে পেরেছেন। রামসিংহের মরদেহটি তিনি দেশেও আনতে পারেননি। এ দুঃখ তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি ঢাকায় ছিলেন। ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে স্বামীনাথান দীর্ঘদিন গ্রামে ছিলেন। দু’ছেলে আর এক মেয়ে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। পেনশন পান মাসে ৯ হাজার টাকা। কোন জমিজমা নেই। ছেলেমেয়েদের সংসারে সহায়তা করতে হয়। পেনশনের টাকায় সংসার চলে না। তাই কাজ নিয়েছেন ভেলোর শহরের আবাসিক হোটেল (যা এখানে লজ হিসেবে পরিচিত) এনবিসি রেসিডেন্সিতে। বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর সাতটা পর্যন্ত সিকিউরিটি কাম বয়ের কাজ করেন। বেতন পান মাসে তিন হাজার টাকা। এখন তাঁর বয়স প্রায় ৭৪ বছর। জীবনে খুব একটা বেশি চাওয়া-পাওয়ার নেই। তবে একটি এবং একমাত্র বড় চাওয়া হচ্ছে- একবারের জন্য হলেও পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পণস্থল অর্থাৎ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখার। সেখানকার মাটি কপালে ঠেকাতে চান। লেখক : সাংবাদিক
×