ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবাদের অভিশাপ বাংলাদেশ মুক্তি পাবে কবে?

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৯ নভেম্বর ২০১৪

জঙ্গীবাদের অভিশাপ বাংলাদেশ মুক্তি পাবে কবে?

জঙ্গীবাদ একটি মধ্যযুগীয় অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, যার মূল কথাই হলো, অস্ত্রের মাধ্যমে সেই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্য ধর্ম মতকে স্বীকার না করা। এই অগণতান্ত্রিক আচরণই জঙ্গীবাদ। আর রাজনৈতিক ইসলামের দর্শনের আবরণেই ইসলামী জঙ্গীবাদের সৃষ্টি। ৯/১১ তে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর আফগানিস্তানে ধর্মান্ধ তালেবানী বিপ্লব বটে। এই ধর্মান্ধ তালেবানী বিপ্লবের ঢেউ পাকিস্তান ছাড়িয়ে বাংলাদেশে এসে আছড়ে পড়ে। অবশ্য ৭৫ পরবর্তী সামরিক ও বেসামরিক শাসকদের ক্ষমতা লিপ্সা ও দূরদর্শিতার অভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও অন্য ধর্মান্ধ মৌলবাদী দলগুলো ছাড় পেয়ে যায়। ছাড় পাওয়ার পর অনুকূল পরিবেশ পেয়েই এ সকল মৌলবাদী দল মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যানারে ইসলামী হুকুমত কায়েমে উঠে পড়ে লেগে যায়। বিভিন্ন সময় এ সকল দলের অধিকাংশ নেতা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসলাম কায়েমের কথা বলে টাকা আনে। এক্ষেত্রে মুফতি আমিনীর কওমি মাদ্রাসাগুলোতে জিহাদী ও অস্ত্র শিক্ষার প্রশিক্ষণের সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়। কাজেই ২০০১ সালের পূর্বেই জঙ্গী অভ্যুত্থানের প্রাথমিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবং জামায়াত ক্ষমতার পার্টনার হওয়ার সুবাদে ও তাদের ছত্রছায়ায় জঙ্গী অভ্যুত্থান ঘটে। এ ব্যাপারে ২০০২ সালের মার্চ মাসে ফারইস্টার্ন ইকোনমিকের সিনিয়র রিপোর্টার ব্রাটিল লিটনার বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৩ মাসের অধিক ঘুরে গিয়ে ফারইস্টার্ন পত্রিকায় বাংলাদেশে জঙ্গী উত্থানের এক প্রতিবেদন ছাপে। আর যায় কই, শুরু হয়ে যায় দেশে বিদেশে সরকারী দলের প্রতিবাদ, হৈচৈ এবং সরকার ব্রাটিল লিটনারকে শত্রু ঘোষণা করে হংকংয়ের এক আদালতে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা করে। জনগণ আজও জানতে পারেনি উক্ত মামলার পরিণতি কি। অথচ সরকার জনগণের ও বিশ্বের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য এই মামলাটি ছিল এক আইওয়াশ। পরে আরো জানা যায়, সরকার গোপনে ঐ পত্রিকা সম্পাদক ও ব্রাটিলের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে আপোস করে। এই প্রবাসে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের ওপর আমার কয়েকটি লেখা ছাপালে এবং আমার রচিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংখ্যালঘু নির্যাতন গ্রন্থে জঙ্গীবাদের উত্থানের কথা প্রকাশ করলে প্রবাসে তখনকার সরকারী নেতাকর্মী, লেখকদের অনেক সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। সেখানে তারা ভারত-বার্মা থেকে বিতাড়িত মুসলিম গেরিলাদের পাচ্ছে ধর্মীয় কারণে বন্ধু হিসেবে। তাছাড়া এদেশে অনেকদিন ধরে আছে রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদের মধ্যেও আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গী। বাংলাদেশের সব সরকারই এদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো অবহেলা করেছে। উখিয়ায় তিনটি প্রশিক্ষণ শিবিরে ২৫০০ যোদ্ধার আশ্রয় ছিল। বড় প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিল ২৫টি সংযোগকারী বাঙ্কার, রান্নাঘর, লেকচার হল, টেলিফোন ও টিভি সেট। প্রশিক্ষণের জন্য ছিল একে ৪৭ রাইফেল, হেভি মেশিনগান, রাইফেল, পিস্তল, রকেটচালিত মর্টার ও গ্রেনেড। এ সকল ক্যাম্প থেকে ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান -চেচনিয়ার জঙ্গীরা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। অথচ জোট শাসনের পাঁচ বছরে ৪৭টি বোমা, গ্রেনেড হামলা এবং এমনকি চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাই দেশে জঙ্গীবাদ উত্থানের দৃষ্টান্ত ছিল। এত কিছুর পরও জোট সরকারের মন্ত্রীরা জঙ্গীবাদ নেই, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টিসহ এমন বক্তব্য দিয়ে জঙ্গীদের আড়াল করতে চেয়েছে। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী শাসনামলে দেশে জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা ছিল মাত্র তিনটি। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা ছিল ৬১টি। বর্তমানে সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৭টি। এদের মধ্যে জোট সরকারের আশীর্বাদে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ শক্তিশালী। ইদানীং নাছিরুল্লার বাংলা টিমের নামও পুলিশের খাতায় উঠেছে। এই জোট শাসনামলে ৬৩ জেলায় তিনশ’ স্থানে একই সময়ে ৫০০টি বোমা হামলা, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যাকা-, ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলা ও ২৪ জনের হত্যাকা-, ২ বিচারপতিকে হত্যা, মুক্তচিন্তার পথিকৃৎ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুস হত্যা, চট্টগ্রামের মুহরি হত্যা, নওগাঁয় কাইয়ুম বাদশাকে হত্যা করে লাশ গাছে ঝুলানো, এক খেজুর আলীকে পাঁচ টুকরা করা, উদীচী ও কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে হামলা ও হত্যাকা-। ময়মনসিংহের ৩টি সিনেমা হলে বোমা হামলাসহ অসংখ্য ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত জোট সরকারের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর হুজির নেতা মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার এবং হুজিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। একই চাপে সরকার জেএমবিপ্রধান শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইকে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গীকে ফাঁসি দেয়ার পর জঙ্গীদের তৎপরতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই জঙ্গীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় এবং তাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দেয়। বাস্তবে আওয়ামী সরকারের গত আমলে দৃশ্যমান জঙ্গী কর্মকা- তেমন কিছু দেখা যায়নি। এতদিন সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে মনে হয়েছিল জঙ্গীবাদ বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গীবাদের বিষয়টি আবার নতুনভাবে আলোচনার ঝড় তুলেছে। গত ২ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড় নামক স্থানে এক বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ ঘটে বাংলাদেশের দুই জেএমবি জঙ্গী সদস্য শাকিল আহমেদ ও সুবাহান ওরফে স্বপন মল নিহত হয়েছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে জেএমবি সদস্য আবদুল হালিম মোল্লা এবং সেই বাড়ি থেকে আটক হয়েছে দুই জেএমবি মহিলা সদস্য রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবি। গোয়েন্দারা তদন্তে জানতে পারে এ সকল জঙ্গী বাংলাদেশের জামায়াত ও জেএমবির সদস্য। তারা পশ্চিমবঙ্গের জামায়াত ও মৌলবাদী ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই তাদের কর্মকা- চালাচ্ছে। এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জেএমবি প্রধান সাইদুর রহমান গোয়েন্দা হেফাজতে জানিয়েছে মুর্শিদাবাদের মাওলানা মুজিবর রহমানই জেএমবির আধ্যাত্মিক গুরু। জেএমবির জঙ্গীরা বর্ধমান থেকে মোটরবাইকে বোমা ও অস্ত্র তৈরির রসদ পৌঁছানো হতো খাগড়াগড়ে। আবার খাগড়াগড়ে তৈরি অস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমা ও গ্রেনেড মোটর ভ্যানযোগে নদিয়া হয়ে মুর্শিদাবাদের লালগোলা সীমান্ত দিয়ে রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রামে পাঠানো হতো। এছাড়া দেশে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীরা গোয়েন্দাদের কাছে বলেছে, তাদের প্রশিক্ষণদাতা প্রবাসী বাংলাদেশী, রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। গোয়েন্দারা আরও জেনেছেন, দীর্ঘদিন যাবত দেশে বিভিন্ন নামে জঙ্গী সংগঠন সংগঠিত করেছে জামায়াত। এরই ধারাবাহিকতায় গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার রাজীব হত্যা, বুয়েট ছাত্র দীপ হত্যা, গোপীবাগের ছয় হত্যাকা- এবং ভিন্নমতাবলম্বী মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকা-। এদেরকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে জবাই করা হয়েছে। তাছাড়া গত দুই মাসে দৈনিক জনকণ্ঠে কয়েকটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা যায়, যা দেশে আবারও ভয়াবহ জঙ্গী তৎপরতার আভাস দেয় । ৯ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠে জেরার মুখে বর্ধমান বিস্ফোরণের দুই মহিলার বাংলাদেশের বিদ্যুতকেন্দ্র উড়িয়ে দেয়ার চক্রান্ত স্বীকার। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে লালমনিরহাটে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে জঙ্গী গোষ্ঠী, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে রিপোর্ট : প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভিআইপিসহ ধর্মীয় প্রতিপক্ষ তাদের হিটলিস্টে। ২৬ অক্টোবর ২০১৪ দৈনিক জনকণ্ঠে আইএসের সঙ্গে এক হওয়ার জন্য জামায়াতের মাস্টার প্ল্যান। ২৭ অক্টোবর ২০১৪ জেএমবির পরিকল্পনা হাসিনা-খালেদা হত্যা। কাজেই উপরোল্লেখিত ঘটনা ও কয়েকটি রিপোর্টই প্রমাণ করে জঙ্গীবাদের তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। বর্তমান আওয়ামী সরকারও জঙ্গী বিষয়ে কঠোর অবস্থানে আছে। এই সেদিন ২৮ সেপ্টেম্বর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের অধিবেশনে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন জঙ্গী দমনে জিরো টলারেন্সের কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জঙ্গী দমন করা সম্ভব কিন্তু নির্মূল করা সম্ভব নয়। সরকার পরিবর্তনে জঙ্গীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কিংবা সীমান্ত পাড়ি দেবে। তাহলে কি জাতির ললাট থেকে জঙ্গীবাদের অভিশাপ মোচন হবে না? দেশের রাজনৈতিক প-িতেরা মনে করেন জাতীয় ঐকমত্য তথা সকল রাজনৈতিক দলের জঙ্গী বিষয়ে সমঝোতাই এনে দিতে পারে জঙ্গী নির্মূলে সহায়তা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জঙ্গী বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট নয়। কারণ বিএনপি প্রধান মিত্র জামায়াতকে নিয়েই আন্দোলন করছে। আর জামায়াতে ইসলামই হচ্ছে সকল জঙ্গী সংগঠনের অভিভাবক বা কোন কোন ক্ষেত্রে সরাসরি সম্পৃক্ত। কাজেই সরকারের উচিত হবে জঙ্গী বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলকে যে কোন প্রকারে আস্থায় আনা।
×