
শিল্প বিপ্লব, পলিথিনের আগ্রাসন এবং বৈশ্বিক বাজারের পরিবর্তনে পাট হারিয়ে ফেলে তার পুরোনো ঐতিহ্য। তারপরেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজারো কৃষক পাট চাষে নিয়োজিত। শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদে নয় বরং হৃদয়ের টানে- ন্যায্য মূল্যের আশায় সোনালী আঁশের স্বপ্ন বুনছেন কৃষকরা।
মুকসুদপুরের সিংগিমারা খালে দেখা গেল এমনই একজন কৃষককে, কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে তিনি পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন। পাট পঁচানোর পর এই আঁশ ছাড়ানোর প্রক্রিয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। গরম রোদে পানির মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে এই কাজ করতে হয়, তবুও তাঁর চোখেমুখে ক্লান্তির চেয়ে ভর করেছে একরাশ আশা—এবছর যদি পাটের দাম ভালো হয়, তাহলে পরিবার নিয়ে কিছুটা স্বস্তিতে থাকা যাবে।
এই কৃষক বলেন, “প্রতি বছর অনেক কষ্ট করে পাট চাষ করি। জমি বোনা থেকে শুরু করে কাটার পর পঁচানো, আঁশ ছাড়ানো এবং শুকানো—সব কিছুতেই পরিশ্রম লাগে অনেক। দাম ভালো না পেলে হতাশ হতে হয়। তবে এবছর আশা করছি ভালো দাম পাবো।”
এই অঞ্চলের কৃষকদের মতে, পাটের উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে। শ্রমিক সংকট, সেচ ব্যয়, সার-কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ কৃষকের কাঁধে বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও যদি বাজারে ন্যায্য দাম না মেলে, তাহলে এই ঐতিহ্যবাহী চাষ থেকে কৃষকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
স্থানীয় একজন অভিজ্ঞ কৃষক জানান, “আমরা যদি পাট বিক্রি করে শ্রমের ন্যায্য মূল্য না পাই, তাহলে ভবিষ্যতে আর পাট চাষ করব কি করে? সরকার যদি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পাট কেনে, বা বাজারে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে, তাহলে আবার আগ্রহ বাড়বে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের পরিবেশবান্ধব কৃষিপণ্যের মধ্যে পাটের গুরুত্ব অনেক। প্লাস্টিক ও পলিথিন নিষিদ্ধের পর বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ও বস্তার চাহিদা বাড়ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে কৃষকদেরকে উৎসাহ দেওয়া, প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পাট প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা জানান, “পাটের সম্ভাবনা অনেক। আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, ভালো বীজ ও সার প্রদানের চেষ্টা করছি। সরকার যদি ন্যায্য দাম নিশ্চিত করে এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ করে, তাহলে আবারো ‘সোনালী আঁশ’ ফিরে আসবে তার পুরোনো ঐতিহ্যে।”
এদিকে, কৃষকরা চান, পাট নিয়ে যেন শুধু মৌসুমি উৎসাহ না থাকে। বছরব্যাপী সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বাজার ব্যবস্থাপনা থাকলে তাঁরা নিয়মিত পাট চাষে আগ্রহী হবেন।
এক সময়কার গর্বের জায়গা ছিল এই আঁশ। আজও সেই গর্ব ফিরে পেতে চায় বাংলাদেশের কৃষক। প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা, সহযোগিতা ও ন্যায্য মূল্য।
ইমরান