
ছবি: জনকণ্ঠ
উত্তরার আকাশ যেন আচমকা এক অদৃশ্য আগুনে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান, এফ-৭বিজিআই, মাঝ আকাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা বিধ্বস্ত হলো ঢাকার মাইলস্টোন কলেজ চত্বরে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে, উঁচু ধোঁয়া ঢেকে দেয় রাজধানীর আকাশ। শ্রেণিকক্ষে বসে থাকা শিক্ষার্থীরা মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুর শিকার কিংবা আজীবনের যন্ত্রণায় পোড়া আত্মা।
এটি শুধুই একটি দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি ভয়ংকর রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, যেখানে পুরনো যুদ্ধবিমানকে উড়ানো হয় জনবহুল শহরের আকাশে, আর শিশুদের প্রাণ যায় সেনা-দুর্নীতির হিসাবের বলি হয়ে।
পুরনো বিমান, ভঙ্গুর রাষ্ট্রনীতি
এই বিমানটি একটি চীনা নির্মিত F-7B জেট, যার ভিত্তি ১৯৬০-এর দশকের সোভিয়েত মিগ-২১। বিশ্বে যখন পঞ্চম প্রজন্মের সুপারসনিক জেট নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে এখনো চলছে অর্ধশতাব্দী পুরনো প্রযুক্তির বিমান।
এটা কি শুধুই বাজেট ঘাটতির ফল? না, এটি একটি রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। যেখানে আধুনিকায়নের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, সেখানে নিরাপত্তা সংস্কার বা প্রশিক্ষণ বিমান আপডেটের কোনো অগ্রাধিকার নেই।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড কাগজে; বাস্তবে চরম অবহেলা
ICAO ও FAA-এর মত আন্তর্জাতিক বিমান নিরাপত্তা সংস্থাগুলো State Safety Program (SSP) ও Safety Management System (SMS) বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেসব নিয়ম কেবল ফাইলের পাতায়, বাস্তবে নেই কোনো বাস্তবায়ন।
গত এক দশকে বিমান বাহিনীর বারবার দুর্ঘটনা, পুরনো বিমানে প্রশিক্ষণ, এবং প্রতিবার তদন্ত রিপোর্ট চাপা পড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, এটি একটি চলমান, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা।
প্রতিরক্ষা বাজেট: কতটা নিরাপত্তায় ব্যয় হয়?
২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৪২,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই বিপুল অর্থের কতটুকু গেছে প্রশিক্ষণ বিমান আধুনিকীকরণ, বা পাইলটদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে?
প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা অস্বচ্ছ অস্ত্র চুক্তি ও পুরনো বিমানের রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়—যেখানে কোনো জবাবদিহি নেই, নেই নিরপেক্ষ নিরীক্ষা।
ঢাকার আকাশ প্রশিক্ষণের জন্য নয় — এটি একটি মৃত্যু ফাঁদ
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর ওপর দিয়ে কেন উড়ছে প্রশিক্ষণ বিমান? কেন প্রশিক্ষণের জন্য উপকূল, পাহাড় বা উত্তরের ফাঁকা অঞ্চলে স্থানান্তর করা হচ্ছে না?
এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই, কারণ এখানে জবাবদিহিতা নেই। নেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাওকির: রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাওকির বেঁচে থাকতে পারতেন—ইজেক্ট করতে পারতেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনিও হয়তো জানতেন, বিমানটি স্কুলে পড়লে আরও অনেক প্রাণ যাবে। তাই তিনি রয়ে গিয়েছিলেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়েছেন।
তাঁর মৃত্যু কেবল দুর্ঘটনা নয়—এটি রাষ্ট্রের হাতে একজন সৈনিকের আত্মাহুতি। এক ‘উড়ন্ত কফিন’ তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। তাওকির শুধু মৃত্যু বরণ করেননি, তিনি রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্নীতির মুখোশ খুলে দিয়ে গেছেন।
কী করণীয় ? এখনই সময় জবাবদিহিতার রাষ্ট্র গঠনের
এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের কাছে একটি জাতীয় জবাবদিহিতার ডাক। এখনই প্রয়োজন:
১. F-7 ও অনুরূপ সব পুরনো যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ বহর থেকে অবিলম্বে প্রত্যাহার।
২. সব প্রশিক্ষণ ফ্লাইট জনবসতি থেকে দূরে, নির্জন এলাকায় স্থানান্তর।
৩. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত SSP ও SMS-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন।
৪. প্রতিরক্ষা বাজেটের স্বচ্ছ নিরীক্ষা ও জনগণের সামনে প্রকাশ।
৫. একটি স্বাধীন দুর্ঘটনা তদন্ত কমিশন গঠন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ।
৬. ঢাকাসহ সব ঘনবসতিপূর্ণ নগরের ওপরকার আকাশসীমা প্রশিক্ষণের জন্য ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণা।
তাওকিরের আত্মত্যাগ যেন আমাদের রাজনৈতিক জাগরণ ঘটায়
লেফটেন্যান্ট তাওকির কোনো রাজনৈতিক নেতা নন, কোনো বক্তৃতা দেননি। কিন্তু তাঁর নিরব আত্মত্যাগ রাষ্ট্রের কাছে হাজারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। এখন নাগরিক সমাজ, রাজনীতি, সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্র—সবার দায়িত্ব এই আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আমরা যদি এখনো না জাগি, তবে আগামী দুর্ঘটনার আগাম গণনা শুরু করে দিন।
এখনই সময় এক ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের—যেখানে জননিরাপত্তা, স্বচ্ছতা, এবং মানুষের জীবনের মূল্য রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার পাবে, আর দুর্নীতির নামে কেউ প্রাণনাশের পরও পার পাবে না।
এখন সিদ্ধান্ত আমাদের—আমরা কি তাওকিরের আত্মত্যাগকে ইতিহাসে হারিয়ে যেতে দেব, না এক নতুন জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে গড়ে তুলব?
লেখক: আলহাজ্ব কবীর আহমেদ ভূঁইয়া, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া ফাউন্ডেশন।
ছামিয়া