
ছবিঃ সংগৃহীত
ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসেছিলেন শিউলি বিশ্বাস। পরণে লাল আর কালো রঙের ফুল তোলা প্রিন্টের শাড়ি, দুই হাতে শাঁখা। কাছে যেতেই বারান্দা থেকে নেমে দাঁড়ান সিঁড়ির উপর। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতেই মৃদু হেসে বলতে লাগলেন, "প্রায় দুইটা মাস কত আতঙ্ক আর দুর্ভোগ কষ্টে কেটেছে। অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। এখন অনেক ভালো আছি। সেনাবাহিনী পাশে দাঁড়িয়েছে। নতুন ঘর পেয়েছি, ঘরের তৈজসপত্র, আসবাবপত্র পেয়েছি। দেওয়া হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নগদ টাকাও।"
শিউলি বিশ্বাস যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী বাড়েদা পাড়ার বিষ্ণু বিশ্বাসের স্ত্রী।
গত ২২ মে পাড়াটির ঘের ব্যবসায়ী পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে কৃষক দল নেতা তরিকুল ইসলামকে কুপিয়ে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর রাতে একদল লোক পিল্টু বিশ্বাসের প্রতিবেশী ১৪টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ১৪টি বাড়িই পুড়ে ভস্ম হয়। তার আগে চলে লুটপাট, ভাঙচুর ও মারধর। এ সময় আহত হন অন্তত ১০ জন। আতঙ্কিত লোকজন প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আশপাশের জঙ্গল, ঘেরের পাড়ে আশ্রয় নেন। ক্ষোভের এই হামলার ঝড় বয়ে গেছে শিউলি বিশ্বাসের জীবনে। সেই মতুয়াপল্লির বাসিন্দাদের মাঝে এখন আতঙ্ক কেটে ফিরছে স্বস্তি। সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুড়ে যাওয়া নিস্তব্ধ বাড়িগুলো নতুন করে জেগে উঠছে। ক্ষতিগ্রস্তরা পেয়েছে নতুন পাকা বাড়ি। বাড়ির সঙ্গে পেয়েছে পুড়ে যাওয়া ঘরের তৈজসপত্র, আসবাবপত্রও।
সোমবার (১৪ জুলাই) বিকালে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪টি পরিবারের মাঝে সংস্কার হওয়া বাড়িঘর হস্তান্তর ও আর্থিক সহায়তা তুলে দেন সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জে. এম. ইমদাদুল ইসলাম।
এ সময় জেলা প্রশাসক আজহারুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর ই আলম সিদ্দিকীসহ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে জিওসি মেজর জেনারেল জে. এম. ইমদাদুল ইসলাম ক্ষতিগ্রস্তদের সংস্কার হওয়া বাড়িঘর পরিদর্শন করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আগুনে পুড়ে ফেটে যাওয়া ভুক্তভোগীদের সেমিপাকা ঘরের দেয়াল নতুন করে করে প্লাস্টার করা হয়েছে। পুড়ে যাওয়া ছাউনির বদলে নতুন রঙিন টিন লাগানো হয়েছে। দেয়ালে করা হয়েছে রঙ। ঘরের ভিতরে পুড়ে যাওয়া ঘরের তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, টেলিভিশন, ফ্রিজ, ফ্যান লাগানো হয়েছে। আর এসব করে দিয়েছে যশোর সেনাবাহিনী।
এই মানবিক উদ্যোগে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিলে তিলে সাজানো সংসারের সব হারিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন পাড়াটির বাসিন্দারা।
পাড়াটির আরেক বাসিন্দা স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, “সব হারিয়ে ছিলাম। আড়াই মাস কত কষ্ট করেছি। বৃষ্টিতে ভিজেছি। এখন সেনাবাহিনীর কল্যাণে নতুন ঘর পেলাম। আগের চেয়ে ভালো ঘর পেয়েছি। ঘরের ফ্যান, ফ্রিজসহ ঘরের ভিতরে যার যা পুড়েছিল, তারা সেটা দিয়েছে। সেনাবাহিনী আমার পুনর্জীবন দিয়েছে।” তবে আতঙ্ক কাটলেও মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনীর টহলের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জে. এম. ইমদাদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “ডহর মশিয়াহাটির একটি হত্যাকাণ্ডের জেরে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিবর্গ ১৪টি পরিবারের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর আমি ক্ষতিগ্রস্তদের পরিদর্শন করি। সেনাবাহিনীর প্রধানের নির্দেশ ছিল এসব পরিবারকে সহযোগিতা করার। সেই লক্ষ্যে গত ১২ জুলাই ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত, পুনঃনির্মাণ ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র প্রদানের কাজ শেষ হয়। সেনাবাহিনী সকল ভালো কাজের সাথে সর্বদাই প্রস্তুত।”
তিনি বলেন, “যারা মানুষকে ক্ষতি করতে চায়, তাদেরকে আমরা শক্ত হাতে প্রতিহত করবো। আমরা কোনোভাবেই আশা করি না, কোনো গোষ্ঠী বা মানুষকে কেউ নির্যাতন করবে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। দেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। ফলে সবার নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের সরকার ও সেনাবাহিনী কাজ করবে।”
প্রসঙ্গত, গেল ২২ মে অভয়নগর ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পাড়াটিতে হামলার পর ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিল যশোর জেলা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এছাড়া জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও তাদের খোঁজখবর ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। এখন পাড়াটিতে বদলে গেছে পুড়ার দৃশ্য। তবে নিশ্চয়তা চেয়েছেন আতঙ্কহীন, ভয়ডরহীন জীবনযাপনের।
ইমরান